জন্মলগ্ন পেরিয়ে চার বছরে পড়ল 'আহারে বাংলা'। ভোজন রসিক বাঙালির কাছে এটা এখন চেনা নাম। বই, গান, খাবার, নামের শেষে 'মেলা' বসিয়ে দিলেই নড়েচড়ে বসে হুজুগে কলকাতাবাসী। আহারে বাংলাও ব্যাতিক্রম নয়। এক ছাদের তলায় রকমারি খাবারের স্বাদ যদি নাও নিতে পারেন, গন্ধ নিতেও চলে যেতে পারেন নিউ টাউন মেলা প্রাঙ্গনে।
২১ থেকে ২৫ নভেম্বর দুপুর ১২ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকছে মেলা। সপ্তাহের মাঝামাঝি হওয়ায় বিকেল না গড়ানো ইস্তক ফাঁকা ফাঁকা থাকে বটে, তবে যেই না অফিস কাছারিতে ঝাঁপ পড়তে শুরু করল, দেখতে দেখতে থিকথিকে ভিড় জমতে শুরু করছে মেলার মাঠে। মেলা প্রাঙ্গনে আস্ত একটা মাঠ রাখা হয়েছে মিষ্টির জন্য। শহরের নামী দামি মিষ্টির দোকান তাদের স্টল দিয়েছে মেলায়। পিঠে পুলির আয়োজনও রয়েছে ভরপুর। তুলসী রসগোল্লা, মোহিনী সন্দেশ, ম্যাঙ্গো ফ্লেভারড পাটিসাপটা, আরও কত কী! এক বয়স্ক মহিলা দুধ পুলি খাচ্ছিলেন আয়েস করে। ভিড়ের মধ্যে মাকে খুঁজে পেয়ে রীতিমতো ধমকে দিলেন মেয়ে, "আরে এসব তো বাড়িতেও হয়। চকলেট পাটিসাপটাটা খাও না"।
মিষ্টির উঠোন পেরোলেই চার চারখানা হল জুড়ে রকমারি দেশ বিদেশের খাবার! কে নেই তাতে? আলিবাবা, নিজাম, গ্লোবাল গ্রিল, হাকা, ও ক্যালকাটা!, আপনজন, বিগ বস, জিশান। রুশ আর জাপানি রসনা চেখে দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে মেলায়। তবে চাইনিজ কিংবা কন্টিনেন্টালের চাইতে মোগলাই খানা কিন্তু ঢের বেশি ভিড় টানছে। হাক্কা কিংবা গ্রেভি চাউমিন-চিলিচিকেন তরুণ প্রজন্মকে বেশি টানে, সে রকমই জানতাম এত দিন। যদিও অফিস ফেরতা তরুণ-তরুণীর যে কটা দল চোখে পড়ল, বেশির ভাগেরই পছন্দের তালিকায় মোগলাই ঘরানা।
হলের বাইরেও মাঠের তিন পাশ জুড়ে রয়েছে সারি সারি খাবারের স্টল। চেখে না দেখলেও নাম শুনে থাকবেন সে সব ব্র্যান্ডেড দোকানের। থিকথিকিয়ে বাড়তে থাকা ভিড়ের একটা বড় অংশ কিন্তু আড্ডা মারতেই গেছেন। কারণ খাবার চেখে দেখার মতো ট্যাকের জোর সবার নেই। সরকারি মেলা আর সরকারের উদ্যোগে মেলা তো এক ব্যাপার নয়। তাই খাবার দাবারের দাম শহর এবং শহরতলীর কত অংশের সাধ্যের মধ্যে, বলা মুশকিল। ১৮/ ২০ টাকায় মিষ্টি পেতে পারেন। ৭০/৮০ তে রোল। কিন্তু আহারে বাংলা থেকে মেইন কোর্সের খাবার অর্ডার দেওয়ার ক্ষমতা হয়তো এখনো খুব বেশি সংখ্যক মধ্যবিত্তের হয়নি। তাহলে কাদের জন্য এই মেলা? উত্তর পাওয়া গেল কেন্দ্রের ডাক বিভাগে কর্মরত অভিষেক ঘোষের কাছে। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে মেলায় আসা অভিষেকবাবু বললেন, "শহরের এক শ্রেণির মানুষের হাতে খুব নতুন নতুন টাকা হয়েছে, তারাই কিন্তু বেশি আসে। সাধারণ মধ্যবিত্তের এখানে আসার তেমন ক্ষমতা নেই"।
মেলার অ্যাপে সমস্ত স্টলের উল্লেখ, সেখানে পাওয়া যায় এমন সব খাদ্য তালিকার দাম, এবং যাবতীয় তথ্য দেওয়া আছে। অর্থাৎ কিনা প্রযুক্তির দিক থেকে কোনো ফাঁক নেই। তবে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানোর ক্ষমতা এ শহরের জনসংখ্যার কত অংশের আছে, প্রশ্ন থেকে যায়। তাহলে কি স্মার্ট ফোন না থাকা, পোশাক আশাকে কেতাদুরস্ত হতে না পারা, চাইনিজ বলতে শুধু 'ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন' বোঝা মানুষগুলোর জন্য এ শহর আর ভাবে না? মেলা প্রাঙ্গনে এক দিকে লোক সংগীতের অনুষ্ঠান হচ্ছিল সন্ধে থেকে। আমাদের মাটির গান তো থাকল, কিন্তু মাটির মানুষগুলো? আহা রে বাংলা!