কারও পিঠে ব্যাগ, কারও হাতে তল্পিতল্পা, কারও মুখে হালকা হাসির রেখা, তো কারও মুখভার। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। দল বেঁধে রওনা দেবে নতুন ঠিকানায়। তার আগে নিয়মমাফিক চলছে তল্লাশি। ‘আসছি’ বলার যো নেই, ‘যাচ্ছি’ বলতে হচ্ছে। কারণ ওরা এখানে আর ফিরবে না। এখানে বলতে, শতাব্দী প্রাচীন আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। গত ১৪ নভেম্বর থেকে এই সংশোধনাগার থেকে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা পাড়ি দিয়েছে নবনির্মিত বারুইপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। এখন থেকে সেখানেই হবে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের যাবতীয় কাজকর্ম।
একদিকে যখন বন্দিদের আগমনে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে নতুন সংশোধনাগার ক্রমশ গমগম করতে শুরু করছে, তখন ৫১ সতীপীঠের অন্যতম কালীঘাট মন্দিরের ঢিলছোড়া দূরত্বের ঐতিহ্যশালী আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে চলছে স্থানান্তরণের কাজ। সংশোধনাগার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মুহূর্তে মোট ১,৭০০ জন বন্দি রয়েছে আলিপুরে। যার মধ্যে ৫০০-৬০০ জন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। শুধুমাত্র এদেরই নিয়ে যাওয়া হবে বারুইপুরে। বাকি বিচারাধীন বন্দিদের সরানো হবে কলকাতার আশপাশের সংশোধানাগারে। ইতিমধ্যেই আন্দাজ পঞ্চাশ জন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে সরানো হয়েছে বারুইপুরে। যত দ্রুত সম্ভব আগামীদিনে বাকিদেরও সরানো হবে। সবটাই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেড়াজালে।
শুধু বন্দিরাই নয়, জেলার ও ডেপুটি জেলারসহ মোট ২১ জনের মতো কর্মীও পাড়ি দিয়েছেন বারুইপুরে। সংশোধনাগার সূত্রে খবর, প্রায় ৩০০ জন কর্মী রয়েছেন আলিপুরে। তবে শুধুমাত্র আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরাই নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আদালতে বিচারাধীন বন্দিদেরও রাখা হবে বারুইপুরের নবনির্মিত সংশোধনাগারে।
আরও পড়ুন, জেল বদল: আলিপুর চলল বারুইপুরে
নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাটে শিফট করলে যেমন আমরা সবরকম ব্যবস্থা করি, যেমন টিভি বসানো বা আলো লাগানো, সেরকম বন্দোবস্ত জোরকদমে করা হচ্ছে বারুইপুরের সংশোধনাগারে। সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, ৩২ ইঞ্চির দুটো টিভি বসানো হচ্ছে সেখানে। সংশোধনাগারের কর্মীদের খানাপিনার জন্য নতুন রাঁধুনীর খোঁজ চলছে। শুধু তাই নয়, আরও বেশ কিছু সামগ্রী গাড়িতে চড়ে আলিপুর থেকে পাড়ি দিচ্ছে বারুইপুরে।
এতদিনকার ঠিকানা বদলে যাচ্ছে। এ যেন নিজের বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে থাকা। বন্দিদের কি মন কেমন করছে? সংশোধনাগারের সূত্র বলছেন, "এটা তো খুব স্বাভাবিক, যে কোনও কারো ক্ষেত্রেই হয়। এখানে এত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে, এখানকার পরিবেশের সঙ্গে অনেকে মানিয়ে নিয়েছে। ফলে নতুন ঠিকানায় কতটা তারা মানিয়ে নিতে পারবে সে নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যেতে তো হবেই।"
১৯০৬ সাল থেকে একের পর এক স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে জওহরলাল নেহরু, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে এঁরা সকলেই বন্দিদশা কাটিয়েছেন এই লাল বাড়িতে। দীনেশ গুপ্ত, দীনেশ মজুমদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, প্রমোদ রঞ্জন চৌধুরীর মতো বিপ্লবীদের ফাঁসি হয়েছে এই আলিপুরেই। আবার অম্বিকা চরণ বসু, ফণীন্দ্রলাল নন্দী, রাধাচরণ পালের মতো বিপ্লবীরা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ তো গেল ইতিহাসের পাতার এক টুকরো কথা। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর আবারও সকলের চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল এই সংশোধনাগার। সালটা ছিল ২০০৪। হ্যাঁ, খুনি আসামী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়েরও ফাঁসি হয়েছিল এখানেই।
আরও পড়ুন, সাথীকে খোলা আকাশ দিতে চান খুনের আসামী বারুইপুরের বন্দি শংকর
বন্দিদের সরানো হচ্ছে নতুন ঠিকানায়, সংশোধনাগারের কর্তারাও সরছেন বারুইপুরে। তবে কী নিয়ে থাকবে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার? সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে, হাজারো ইতিহাস আঁকড়ে এ শহরকে স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটাবে সে, কারণ সংশোধনাগারের একটা অংশে মিউজিয়াম তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে খবর।
এদিকে সংশোধনাগার থেকে প্রায়শই উদ্ধার করা হচ্ছে মোবাইল ফোন। শুধু মোবাইল নয়, উদ্ধার করা হচ্ছে গাঁজার প্যাকেটও। গত জানুয়ারি মাস থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে বলে সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে। বন্দিদের নয়া ঠিকানায় এ ধরনের সামগ্রীর উৎপাত কি কমবে? জবাবে সংশোধনাগারের এক আধিকারিক বললেন, "অনেকটাই কমবে বলে আশা করছি।" বারুইপুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও আঁটোসাঁটো করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। ফলে সেখানে বন্দিদের মধ্যে গাঁজা বা মোবাইলের মতো সামগ্রী মেলা দুষ্কর হবে বলেই মত অনেকের।