বিহারের দশরথ মাঝিকে মনে আছে? ২২ বছর ধরে লোকটা একার চেষ্টায় পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। লোকে দশরথ মাঝিকে ভুলেই গেছিল। কয়েক বছর আগে তাকে নিয়ে সিনেমা হওয়ায় কয়েকজন যা জেনেছে একটু আধটু। তেমনই 'সুবাসিনী মিস্ত্রী'- এই নামটার সঙ্গেও আমরা পরিচিত হয়েছি হালে, তাও আবার পদ্মশ্রী সম্মানের খাতিরে। সম্মান, পরিচিতি, খ্যাতি - শব্দগুলো বড় তুচ্ছ লাগে সুবাসিনীর লড়াই-এর কাছে। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি, সাফল্য অর্জনের লড়াই নয়, সুবাসিনী স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকগুলো প্রাণের জন্য। স্বপ্ন দেখার শুরু অবশ্য দুঃস্বপ্নের হাত ধরে।
২৩ বছর বয়সে সুবাসিনীর স্বামী মারা যান বিনা চিকিৎসায়। সেই সময় থেকে সব্জি বিক্রি করে, বাড়ি বাড়ি কাজ করে ছেলেকে চিকিৎসক বানালেন। এ পর্যন্ত গল্পটা মোটামুটি চেনা। কিন্তু জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার এই লড়াই-এর সঙ্গে সমান্তরালে চলছিল অবিরাম স্বপ্ন দেখা, আর তাকে সত্যি করার অদম্য জেদ- চিকিৎসা না পেয়ে যেন আর একটিও প্রাণকে ফুরিয়ে যেতে না হয়। চার দশক ধরে বয়ে বেড়ানো জেদ থেকে জন্ম নিল 'হিউম্যানিটি হসপিটাল'। প্রান্তিক মানুষের জন্য বিনা খরচায় হাসপাতাল। কালে ক্রমে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে পরিণত হল তা।
আরও পড়ুন, আমার দুর্গা: দ্য উইনার্স
আবেগ থেকে নয়, সমাজের সব হারানো মানুষগুলোর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মায়ের স্বপ্নকে সত্যি হতে দেখবে বলেই রসায়ন নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়া শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে নতুন করে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন সুবাসিনীর ছোট ছেলে অজয় মিস্ত্রী। চিকিৎসকের ঝা চকচকে কেরিয়ারের তোয়াক্কা করেননি অজয়। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত, দুই যাপন উজাড় করে দিয়েছেন গরিব মানুষের চিকিৎসায়। ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে হাসপাতাল খুলেই স্বপ্ন ফুরোয়নি মা-ছেলের। শরীরে সময় ফন্দি এঁটেছে মায়ের। তাই হাঁসপুকুরের হাসপাতাল ছেড়ে দূরদূরান্তে যাওয়া হয় না তাঁর।
পুজোয় নতুন সাজ, নতুন মণ্ডপ, নতুন থিমের ভাবনায় মশগুল আমরা। ঢাকের আওয়াজ, আলোর রোশনাইয়ের আবডালে ধুকতে থাকা যেসব জীবনের গল্পে আমরা চোখ বোলাব না একটা বারের জন্যেও, সুবাসিনীর পুজো-প্রার্থনা সব তাদের জন্য। ষষ্ঠী থেকে দশমীও কাটে শুশ্রূষায়। ফোনের ওপার থেকে মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় সুবাসিনী বললেন, "আমাদের আবার পুজো কী? হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে এতগুলো মানুষ, ওদের সাথেই পুজো কাটবে"।
বছরের এই সময়ে হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক ছুটিতে থাকায় বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয় অজয়বাবুকেও। এতটুকু বিরক্তি না দেখিয়ে নিষ্ঠা ভরে সেবা করে চলেছেন। গলায় আক্ষেপের সুর, "রাজ্যের ক্লিনিকাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট আমাদের পক্ষে না থাকায় কতদিন নিখরচায় চিকিৎসা চালানো সম্ভব হবে, জানিনা। গরিব মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে এমনিতেই আমাদের বিপুল খরচের বোঝা বইতে হয়। তার ওপর বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স পেতে রাজ্য সরকারকে যে পরিমাণ টাকা দিতে হয়, আমাদের থেকেও সেটাই নেওয়া হচ্ছে"।
ঘরের মেয়ে ঘরে ফেরার আনন্দে চারপাশে কত আয়োজন,আলো-হাসি-গান। আর অন্যদিকে নিভে যাওয়া আঁচে বাঁচতে থাকা প্রাণগুলোকে ঘরে ফেরানোর জন্য জেগে আছে সুবাসিনীরা।