লক্ষ লক্ষ মুসলিম দুনিয়া জুড়ে ঈদুজ্জোহা বা বকরি ঈদ পালনে মেতেছেন। এটি ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। প্রতি বছর হজ শেষে এবং আল্লাহের ইচ্ছায় নবী ইব্রাহিমের ছেলের জীবন শেষ করার আকাঙ্ক্ষার স্মরণে এ উৎসব পালিত হয়।
মহম্মদের সময় থেকে মুসলিমরা ইব্রাহিমের উৎসর্গের উৎসাহকে সম্মান জানাতে পশু বলি (কুরবানি) দিয়ে থাকেন।
তবে ইদুজ্জোহা কিন্তু রক্তপাতের মাধ্যমে ঈশ্বরকে খুশি করার উৎসব নয়। নিজের প্রিয় কোনও কিছু ঈশ্বরের উদ্দেশে সমর্পণ করাই এ উৎসবের উদ্দেশ্য। কুরবানির পশুর মাংস তিন ভাগে বণ্টন করতে হয়, এক ভাগ নিজের জন্য, অন্য এক ভাগ বন্ধু ও পরিবারের জন্য ও তৃতীয় ভাগ দরিদ্র মানুষের জন্য।
এ উৎসবের বার্তা খুব স্পষ্ট, এখানে ভক্তির সঙ্গে থাকে দান ও সমতার ধারণা। কোরাণে বলা রয়েছে, "ওদের মাংস আল্লাহের কাছে পৌঁছবে না, ওদের রক্তও আল্লাহের কাছে পৌঁছবে না, যা তাঁর কাছে পৌঁছবে, তা হল তোমার ভক্তি"। (২২:৩৭)
ইতিহাস
কোরাণে আছে আল্লাহ নবী ইব্রাহিমের স্বপ্নে এসে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছুকে উৎসর্গ করার জন্য। ইব্রাহিম তাঁর পুত্র ইসমাইলের চোখ বেঁধে তার গলা কেটে দেন। ইব্রাহিম যখন চোখ খোলেন তখন তিনি দেখেন ছেলে বেঁচে রয়েছে, নিহত হয়েছে একটি পশু।
এ ধরনের কাহিনি মেলে অন্য ধর্মগ্রন্থেও।
অনেক মুসলমানই পশু কেনেন, তাদের যত্ন করে পালন করেন এবং তারপর তা জবাই করেন ঈশ্বরের উদ্দেশে- এই গোটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে গিয়ে তাঁরা নবী ইব্রাহিমের যন্ত্রণা নিজেদের মধ্যে অনুভব করেন।
ইসলাম মেনে নিয়েছে যে সব মুসলমানের পক্ষে পশু লালন করা সম্ভব নয়। যাঁরা তেমনটা পারেন না, তাঁরা অন্যদের উপর সে দায়িত্ব দেন, তার জন্য কিছু অর্থ দিয়ে থাকেন তাঁরা।
সহভাগিতা, করুণা নয়
ইসলামে ইদুজ্জোহায় উৎসর্গ শুধু তাদের জন্যই বাধ্যতামূলক, যাঁরা তা করতে সক্ষম। জবাই করা মাংসের এক তৃতীয়াংশ গরিব মানুষকে দিতে হয় তাঁদের। যাঁরা সারা বছর মাংস কিনতে পারেন না, তাঁরাও যাতে বছরে এক দিন যথেষ্ট পরিমাণে মাংস পান, তা নিশ্চিত হয় এ উৎসবে। মক্কায় হাজিরা যে পশু জবাই করেন, তার এক তৃতীয়াংশ বিলোনো হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেও।
ইসলামে দাক্ষিণ্যের কথা সুস্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, ইদুজ্জোহায় যেমন এক তৃতীয়াংশ মাংস, অন্য দিন গুলিতে তেমন উপার্জনের একাংশ, জাকাত হিসেবে।
সহভাগিতা যেহেতু এ ধর্মে বাধ্যতামূলক, ফলে দরিদ্র মানুষ মাথা উঁচু করেই তা গ্রহণ করতে পারেন। কারও কাছ থেকে মাংস নেওয়া বা জাকাতের অর্থগ্রহণ অবমাননাকর নয় কারণ এই গ্রহণের মাধ্যমে দাতার ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্বপালনে সাহায্য করছেন তিনি।
সমালোচনা, প্রশ্ন
ইদুজ্জোহায় পশু উৎসর্গ নিয়ে এখন বেশি করে নানা রকম প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় য়ে আমরা খাদ্যের জন্য পশুহত্যা করে থাকি, যা মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন, কখনওই হিংস্রতা উৎপাদনের জন্য নয়।
মাংস খাওয়া কেবল মুসলিমদের বিষয় নয়, সারা দুনিয়ার মানুষ মাংস খেয়ে থাকেন। নিরামিষাশী হওয়া একটি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়, কোনও নৈতিকতার চিহ্ন নয়। বহু দেশে জলবায়ুর কারণেই মাংস না-খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় উৎস হিসেবে মাংস অনেক শস্তাও বটে, নিরামিষ বিকল্প গ্রহণ করা সকলের সাধ্যের মধ্যে নয়।
পশুর উৎসর্গ শুধু ইসলামের বিষয় নয়। হিন্দু ধর্মে, বহু দেবতার পুজায় পশুবলি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
এসব সত্ত্বেও মাংসভক্ষণ নিয়ে নৈতিকতার প্রসঙ্গ প্রতি বছর ইদুজ্জোহার সময়ে সামনে চলে আসে। মাংস খাওয়া নিয়ে অপরাধবোধের জন্ম দিতে চাওয়া হয় নানা ভাবে। ভারতের মত দেশে সম্প্রতি এ ধরনের প্রচেষ্টার কারণ যে পশুপ্রেম নয়, তা সহজেই অনুমেয়।
Read the Full Story in English