বড়দিন সদ্য পেরিয়ে এলেন না? নাহ, আজ আবার বড়দিন, জানতেন? ঠাট্টা নয়, সত্যিই ৬ জানুয়ারি শহরে পালিত হচ্ছে বড়দিন। তাও আবার খাস কলকাতায়। কী, কেন, এসব জানতে হলে একটা গলিতে ঢুকতে হবে।
ঘুপচি গলি। দু'পাশে কানের দুল, পুঁতির মালা, টুনি বালব, রঙবেরঙের বাহারি কাগজের পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। গলি দিয়ে ঢুকেছেন কী ঢোকেননি, অথবা গুঁতোগুঁতি করছেন, হাঁক শুনবেন দু'পাশ থেকে, "ও দিদি, কী লাগবে? সব পেয়ে যাবেন। ভালো কালেকশন এসছে।" এ ডাক উপেক্ষা করে কিংবা না করে, খানিক সময় নিয়ে যদি সামান্য এগিয়ে যান, পাহাড়প্রমাণ এক দরজা পড়বে রাস্তার ধারেই। দরজার ওপারে কিন্তু ইতিহাস। কলকাতা যখন তার নাম পায়নি, সে সময়কার ইতিহাস।
আর্মানি গির্জা। সহজ পাঠের পাতায় প্রথম পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের 'জীবন স্মৃতি'-তেও একাধিকবার ফিরে ফিরে এসেছে আর্মানি গির্জার ঘড়িতে ঘন্টা বাজার কথা। এখন শহরের ব্যস্ত ঘিঞ্জি রাস্তায় কোলাহল ছাপিয়ে ঘন্টার শব্দ কানে আসে কী না, জানা নেই যদিও। পোশাকি নাম ‘আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব নাজারেথ'। এই গির্জার বয়স খাতায় কলমে ৩০০ বছরের বেশি। কলকাতার সবচেয়ে পুরনো গির্জা কিন্তু এটাই - হোলি নাজারেথ গির্জা। এবং কাল এখানেই পালিত হতে চলেছে বড়দিন।
আমাদের অনেকেরই জানা নেই, ২৫ ডিসেম্বর নয়, আর্মেনিয়ার মানুষ বড়দিন পালন করেন জানুয়ারির ৬ তারিখ। আমাদের কলকাতার বুকে যে এক টুকরো আর্মেনিয়া, সেখানেও নিয়মটা খুব কিছু আলাদা নয়।
গির্জার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৬৮৮ সালে তৈরি প্রথম স্থাপত্যটি ছিল কাঠের। শোনা যায়, ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সেটি। নতুন করে তৈরি করার পর ১৭২৪ সালে আজকের চেহারায় আসে 'আর্মেনিয়ান চার্চ অব দ্য হোলি নাজারেথ'। ১৭৩৪ সালে চার্চের মাথায় চূড়াটি তৈরি করেন আগা নজর।
গির্জার স্থাপত্যে জাঁকজমক নেই তেমন। বেশ আমে-জামে ঘেরা ছিমছাম চত্বর। উপাসনা ভবন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে যে স্মৃতিসৌধ, তা বিশ্বযুদ্ধে নিহত ১০ লক্ষেরও বেশি আর্মেনীয় সৈনিকের স্মরণে তৈরি। রবিবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা প্রার্থনা হয় গির্জায়। কলকাতায় যে ক'টি হাতে গোনা আর্মেনীয় পরিবার রয়েছেন, প্রার্থনায় অংশ নেন তাঁরা। আর আসে আবাসিক আর্মেনিয়ান কলেজের পড়ুয়ারা। নামেই কলেজ, আসলে কিন্তু স্কুল। ইরান থেকে আসা আবাসিক পড়ুয়ারা এসে যোগ দেয় সাপ্তাহিক প্রার্থনায়।
কিন্তু কেন এমন সৃষ্টিছাড়া বড়দিন? খ্রিস্টধর্ম নিয়ে চর্চা করা গবেষকরা বলেন, যীশুর জন্মের আসল দিনটি নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। চতুর্থ শতক পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মাবলম্বী প্রতিটি দেশ জানুয়ারির ৬ তারিখেই যীশুর জন্মোত্সব উদযাপন করত। ২৫ ডিসেম্বর পালন করা হত অখৃষ্টান উত্সব। ওই দিনটিকে সূর্যের জন্মদিন হিসেবে মানা হত অনেক দেশেই। দিনটির গুরুত্ব যাতে চাপা পড়ে যায়, তাই রোমান ক্যাথলিক চার্চের কর্তৃপক্ষ সারা পৃথিবী জুড়ে ২৫ ডিসেম্বর দিনটিকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করে দেন।
বাদ পড়ে রইল শুধু আর্মেনিয়া। তার পেছনেও অবশ্য দু'টো কারণ। প্রথমত, আর্মেনিয়ায় অখৃষ্টান উত্সবের প্রচলন ছিল না। তাছাড়া, এটি রোমান ক্যাথলিক চার্চের আওতায় পড়ে না।
তবে হোলি নাজারেথ চত্বরে গির্জা হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেটি ছিল আর্মেনীয়দের সমাধিক্ষেত্র। বছর কয়েক আগে গির্জা চত্বরে ১৬৩০ সালের একটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়। সমাধিটি আর্মেনিয়ান মহিলা রেজাবেবাহ্-র। তাঁর স্বামী কলকাতায় পরিচিত ছিলেন 'চ্যারিটেবল' সুকিয়া নামে। খুব সম্ভবত এঁর নামেই কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট। রেজাবেবাহ্-র সমাধিটি এখন পর্যন্ত পাওয়া বাংলার প্রাচীনতম খ্রিস্টান সমাধি।
কলকাতার মাটিতে ১৬৩০-এর জুলাই মাসে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বেশ কিছু বছর এখানে ছিলেন নিশ্চয়ই তিনি। সে তো প্রায় চারশো বছর আগের গল্প। ইংরেজরা তখন কোথায়? আর মাস কয়েকের মধ্যে পৃথিবীর আলো দেখবেন জোব চার্নক। আর তারও প্রায় ষাট বছর পর তাঁর জাহাজ নোঙর ফেলবে বাংলায়। অথচ স্বাধীনতার পর সাত দশক কেটে গেছে, কিন্তু স্বাধীন হয়নি ইতিহাস। এখনও কলকাতার ইতিহাস রয়ে গেছে তিনশো বছরের পুরোনো।
এশিয়া এবং ইয়োরোপের সীমান্তে ককেশীয় পার্বত্য অঞ্চল ছিল আর্মেনীয়দের আদি বাসভূমি। এখান থেকেই ভারতে এসেছিলেন ওঁরা। মূলত ব্যবসা করে এ দেশে প্রচুর নাম ডাক হয়েছিল আর্মেনীয়দের। কিন্তু বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডে বদলে ফেলার ইচ্ছেটা এঁদের কোনো দিনই ছিল না। ইতিহাস বলছে, মুঘল এবং ইংরেজ, সবার সঙ্গেই সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল আর্মেনীয়দের। সম্রাট আকবর খুব খাতির করতেন এঁদের। তাঁর শাসনকালেই আগ্রায় তৈরি হয় আর্মেনীয় গির্জা। ভারতে পশম, আয়না, বন্দুক আমদানি করতেন এঁরা। বদলে দেশ থেকে নিয়ে যেতেন সুতির কাপড়, মশলা, মুক্তো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করার ব্যাপারেও এঁরাই সাহায্য করেছিলেন।
চারশো বছর ধরে এই কলকাতার বুকে, এই শহরকে ভালোবেসে মিশে আছেন আমাদের সাথে। পাশাপাশি অতি সযত্নে, ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় লালিত এবং চর্চিত হয়ে চলেছে কলকাতার তিনশ বছরের ইতিহাস।