Advertisment

প্রবাসীনির চিঠি: যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে চলুন যাই 'ই-হারিয়ে'!

যা দেখছি, যেখানে যাচ্ছি, তা শুধু নিজের মনের কোণায় রেখে দেওয়ার সাহস আছে? কাউকে দেখাতে পারবে না, ছবি তোলো, কিন্তু ‘শেয়ার’ করতে পারবে না। নিজের নিঃশ্বাস শুধু নিজেই বুক ভরে নিতে পারবে, অন্য কারোর ঘাড়ে ফেলতে পারবে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Letter from Canada blog

অলংকরণ: অরিত্র দে

আমার দিদা অনেক বয়েসকালে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করেছিলেন। একটা চটি বই দাদু কিনে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর জীবনের বাকি কাজ শেষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে, নাতিনাতনি ভরা সংসার। দুপুরে খেয়ে, শীতকালে, ছত্রী-দেওয়া খাটে, খোলা জানলার ঢালা রোদে পা-ছড়িয়ে বসে আওড়াতেন, "P-I-L-L-O-W = ফু-লি-শ, ফুলিশ মানে বা-লি-কা। P-I-L-L-O-W = ফু-লি-শ, ফুলিশ মানে বা-লি-কা।" দাদু ঘরে ঢুকেই হোহো করে হেসে উঠে বলতেন, "ছেড়ে দাও না বাবা!"

Advertisment

আমার আজকাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বহর দেখলে তাই মনে হয়। মনে হয়, “ছেড়ে দে না বাবা!” লিখতে গেলাম T-O-A-S-T, হয়ে গেল G-O-A-T। লিখতে চাইলাম 'Hi, I am great!' হয়ে গেল 'greasy'. জন্মদিনে স্বামীকে বলতে গেলাম, 'Happy Birthday Dear Husband', হয়ে গেল 'Happy Birthday Dead Husband'. ছেলেকে লিখতে গেলাম, 'আসার সময় একটা PRINGLES নিয়ে আসিস', হয়ে গেল 'PREGNANT নিয়ে আসিস'। এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে, যা শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হয়।

ছেড়ে দে না বাবা! কে বলেছিল মানুষের সাথে পাল্লা দিতে?
এই অটো-কারেক্টের দৌলতে আমার এক বন্ধু তিলোত্তমার নামে ইলেকট্রিক বিল এলো, লেখা 'কিলোত্তমা'। সব কি আর যন্ত্ররা পারে? বললেই হল? অটো কারেক্টের ভয় সব সময় কোন কিছু লিখে পাঠানোর আগে ভালো করে দেখে নিই, কোথাও কোন অশ্লীল কথা বসে যাচ্ছে না তো?

আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: অনেক হয়েছে, এবার চললাম টরন্টো থেকে কলকাতা, ট্রেনে করে

শুধু অটো কারেক্ট? আমাদের প্রজন্মের ওপর দিয়ে কম ঝড় যাচ্ছে? লাল ফিতে-লাল জুতো পরে বিকেলে পার্কে খেলতে যাওয়া প্রজন্ম আমরা, সেই রেডিও পেরিয়ে সাদা-কালো টিভির যুগ, কালার টিভি, টিভির বড়-হওয়া, ছোটো-হওয়া, আবার বড়-হওয়া পেরিয়ে, কম্প্যুটারে পৌঁছলাম। কম্প্যুটারে ডস, ওয়ার্ড, এক্সেল, আডোবি, আলডাস, আরো কত কি ঝুট-ঝামেলা পেরিয়ে এসে পড়লাম আর্টিফিশিয়াল মানুষদের খপ্পরে। মাঝে একটু দাবড়ালো পেজার, নানান চরিত্রের মোবাইল, মোবাইল ছোট হলো, বড় হলো, ছোট হলো, বড় হলো। এরপরেই এসে গেলো ঘোর কলিযুগ, অর্থাৎ, স্মার্টফোনের যুগ।

এখন তো সবার হাতেই স্মার্টফোন। ঘাড়ের ওপর সিসিটিভি। মাথার ওপরে ভগবান না, মাথার ওপরে স্যাটেলাইট। মা স্যাটেলাইট, বাবা স্যাটেলাইট, আর তার ওপর স্বয়ম্ভু - ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন! কোথায় যাচ্ছ, কী খাচ্ছ, কতবার হাসলে, কতবার হাঁচলে, সব কিছু নথিভুক্ত। আর এই নথির ওপর ভরসা করেই তোমার ব্যাঙ্ক লোন, তোমার চাকরি, তোমার বিবাহিত জীবন, সব কিছু। এ কী দিন পড়েছে! কবে যে শেষ হবে? হবে না, শেষ হবে না, আরও বাড়বে। আমরা শেষ হয়ে যাব, যন্ত্র থেকে যাবে। আর আমাদের জ্বালাবে।

যন্ত্রের জ্বালার চোটে বাড়ির থেকে বেরোতে, লিফট দিয়ে নামতে, অসোয়াস্তি হয়। ঘাড়ের ওপর ক্যামেরা। অহরহ। অর্থাৎ, লিফটে ঢুকে সাথিকে জড়িয়ে ধরার দিন শেষ। আমি কাউকেই জড়াচ্ছি না, কিন্তু সেদিন লিফটে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। এক যুগল দরজা খুলে যেতেই দেখি খুবই অপ্রস্তুত অবস্থায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, দেখেই আমি মনে মনে জিভ কাটলাম। ইশ, আমি যে অজান্তে কী কবাব-মে-হাড্ডি হলাম! কিন্তু কবাব-মে-হাড্ডি তো আগের থেকেই রয়েছে বাবা তাদের মাথার ওপরে। তারা কি সেটা জানত না? মানে চারখানা মনিটর বসানো বিল্ডিঙের অফিসে, ক্যামেরা চলছে লিফটে, করিডোরে, চারিদিকে। সব ক্যামেরাই কাজ করে। যে কেউ অফিসে ঢুকলেই দেখতে পাবে কোথায় কী হচ্ছে।

আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: আমায় আবার বিয়ে করতে বোলো না

শুধু লিফটে? ক্যানাডায় পুরো দেশটাই চলে ক্যামেরার ভরসায়। সেটা নাকি "আমাদের সুরক্ষার" জন্য। কিন্তু সারাক্ষণ এত সুরক্ষা থেকে কিভাবে সুরক্ষা পাওয়া যায়? বাড়ি থেকে বেরোনোয় অসোয়াস্তি। সারাক্ষণ নীতিগতভাবে, আইনগতভাবে নির্ভুল হতে হবে। হাঁটায়-চলায়-গাড়ি চালানোয়। শুধু ক্যামেরায় হয় না, আবার ড্রোন রয়েছে লুকিয়ে আনাচে-কানাচে। কোথায় কী একটা কাগজ ফেলেছ রাস্তায় কী বাড়িতে ইয়াবড় একটা বিল চলে এল। সব সময় দম আটকে থাকে, এই যাঃ! কে কী দেখে ফেলল!

আমাদের পুরো অস্তিত্বটাই অনলাইন নথিভুক্ত। ব্যাঙ্কে ফোন করলে আজকাল নাকি গলার স্বর শুনেই রোবটরা পরিচয় পেয়ে যায়। অনেক কষ্টে একটা মানুষকে ধরতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা, যদি আমার গলা ধরা থাকে, বা সর্দি হয়, তাহলে?" ব্যাঙ্কের সুমধুরভাষিণী হেসে বললেন, "এ-আই সব বুঝতে পারবে।" অর্থাৎ, এ-আই ভগবান, এবার থেকে পুজোর স্থলে একটা এ-আই-এর মুর্তি বসাতে হবে। পুজোর সময় একবার করে এ-আই কে স্মরণ করতে হবে। এ-আই পুজোর ছুটি চাই। কলকাতা তো লাফিয়ে উঠবে আর একটা ছুটি পাবে বলে। প্যান্ডেল হবে, মাইকে গান চলবে, 'ইয়ে এ-আই মস্তান নে, মজবুর কর দিয়া...'

আজকাল 'অ্যালেক্সা' নামক এক কাজের লোক পাওয়া যায়। কুঁড়েদের জন্য। “অ্যালেক্সা, পাখা বাড়িয়ে দাও”, “অ্যালেক্সা, টিভি চালিয়ে দাও”, “অ্যালেক্সা, আজ কি বরফ পড়বে?” “অ্যালেক্সা, মাথা টিপে দাও”। আর এই অ্যালেক্সার সঙ্গে যা যা কথা হয় সাধারণ মানুষের, সে সব কথা নাকি অ্যামাজন আর গুগলের কর্মিদের অফ-টাইমের খোরাক। মানে চাই না চাই, গুগল আমার গলার আওয়াজ চিনে রাখবে। গলা টিপে ধরার জন্য গলা চিনে রাখল। যাক গে, কদিন মজা লুটে নে! তারপর "ম্যায় হি নহি রহুঙ্গা, তো মুঝে কেয়া ফরক পড়েগা।"

আরও পড়ুন: ক্যানাডায় মন ভরিয়ে দিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’

চোখের মণি এবং হাতের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে পরিচয় নির্ণয় করা তো অনেক দিন হয়ে গেল। এবার দেশে গিয়ে দেখলাম, সকলে বুড়ো আঙ্গুল পাঞ্চ করে অফিসে ঢুকছে। সবাই নিশ্চয়ই জানেন যে খুব শীঘ্রই আমাদের শরীরে চিপ বসানো শুরু হবে, এবং এমন ব্যবস্থা করবে যে চাও না চাও, চিপ ঢোকাতেই হবে। চিপের আমি, চিপের তুমি, চিপ দিয়ে যাবে চেনা। কারোর সাথে দেখা হলে চিপে-চিপে চেপে পরিচয় শাণিয়ে নিতে হবে। চিপেই জীবন, চিপ না থাকলে তুমি নেই। আমরা মরব, আমাদের আত্মা আর চিপ থেকে যাবে।

আর স্মার্টফোনের কথা তো বলাই বাহুল্য। কুকুরের বক্লসের মতোন আমাদের অদৃশ্য চেনে বেঁধে রাখে। ফোন যত না আমার দরকার, তার চেয়ে বেশি অন্যদের। তারা ফোনে না পেলে বলবে, "কী রে? কোথায় থাকিস? ফোন করলে ধরিস না?" দরকারি কোনও খবর বা লেখা পড়তে যাওয়া মানে হাজারো ঝামেলা, সাবস্ক্রাইব করো, নোটিফিকেশন অ্যালাও করো, চ্যাট করো। আরে কী মুশকিল! একটু শান্তিতে কিছু পড়তে দেয় না তো!

ফেসবুক তো আবার ওত পেতে বসে থাকে আপনি কিছু সার্চ করছেন কী না। সব ওয়েবসাইট থেকে আপনার নথিপত্র যোগাড় করছে আর অন্যদের বিক্রি করছে সারাক্ষণ। সুতরাং, আপনি যদি অ্যামাজনে কিছু কেনার জন্য সার্চ করেন, পরদিন থেকেই ফেসবুকে দেখবেন ওই সব জিনিসের বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনে একবার ‘ক্লিক’ করলেই হলো, আপনি তো ধ্বসলেনই, ফেসবুকও মুনাফা করল। এমনকি ‘ক্লিক’ করতেও হবে না। জানেন কি, মাউসটা রোল করালেই সবাই জানতে পারে আপনি কী দেখছেন? আর সে অনুযায়ী আপনার ফেসবুক দেওয়ালে বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে?

বলাই বাহুল্য, ফেসবুক এখন কার্যত আমাদের পরিচয়পত্র। আমরা বেঁচে থাকি বা না থাকি, ফেসবুকের অ্যাকাউন্টটা থেকেই যাবে। খুবই অদ্ভুত, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি। সাম্প্রতিককালে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর মৃত্যু হয়। তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখি, সকলে তার টাইমলাইনে তাকেই উদ্দ্যেশ্য করে সমবেদনা জানাচ্ছে। যেন সে পড়তে পারবে।

আগেকার দিনে পার্সোনাল ডায়েরি কেউ পড়লে কী রেগে যেতাম! আর আজকাল পার্সোনাল ডায়েরি, থুড়ি, ফেসবুকে আমার কথা কেউ না পড়লে সে বন্ধু লিস্ট থেকে বাদ। ‘আড়ি’-র নতুন প্রতিশব্দ, 'unfriend'। যা খাচ্ছি, যা পরছি, যেখানে যাচ্ছি, যা ভাবছি, সব ফেসবুকে না লিখলে কিরকম খালি খালি লাগে। মানে যেন দিনটা শেষ হলো না। অনেকদিন বাদে কারোর সঙ্গে রাস্তায় দেখা। "কী রে! কী খবর? কতদিন দেখা নেই... এই দাঁড়া একটা ছবি তুলি।ফেসবুকে দিতে হবে।... সমিতা ধরো ধরো, কাবেরীদিকে জড়িয়ে ধরো, যেমন ধরবে অনেকদিন পরে দেখা হলে, কাবেরীদি, একটু চোখে জল আনো, একটা ভিডিও করি, প্রচুর ‘লাইক’ আসবে।"

রোজ রোজ এই জীবন থিয়েটারে বিনা-মজুরীর অভিনয় কি আর পোষায়? কিন্তু উপায় কী? এই পঙ্কিল চক্রান্ত থেকে বেরোই কী করে?

চক্রান্ত বলতে মনে পড়ল, ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড গছানোর জন্য কুঁইকুঁই। আর যেই নেওয়া, অমনি রণমূর্তি! এমন সব ব্যবস্থা, যে আপনি ইচ্ছে করলেও সেই চক্রব্যূহ থেকে বেরোতে পারবেন না। ধারের পাহাড় চাপবে ঘাড়ের ওপর ধীরে ধীরে, শোধ এমনতর, প্রতিশোধ মনে হয়। যেন শাস্তি দিচ্ছে! নিঃশব্দে শুষে নিচ্ছে। এমন প্রতিশোধ চরম শত্রুও নেয় না। ক্রেডিট কার্ডের ধার এবং ধারালো ক্ষুর রূপী  ইন্টারেস্ট আপনাকে শোধ করতেই হবে, সারা জীবন ধরে, সে আপনি পাতালেই যান না কেন। শুধু মারা গেলে মনে হয় আর শোধ দিতে হবে না। (যদি না আপনার সঙ্গে অন্য কারোর নাম জড়ানো থাকে)।

আরও পড়ুন: প্রবাসিনীর চিঠি: কানাডায় ইউথেনেসিয়া

এই যন্ত্রের চক্রান্ত আর যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায় - চলে যাই হিমালয়ের কোন উপত্যকায়, যেখানে প্রযুক্তি এখনও বিলম্বিত। চলে যাই এমন এক পাহাড়ি এলাকায়, এমন এক গ্রামে, যেখানে ইন্টারনেট পৌঁছয়নি এখনও। সে সাহস কার আছে? যা দেখছি, যেখানে যাচ্ছি, তা শুধু নিজের মনের কোণায় রেখে দেওয়ার সাহস আছে? কাউকে দেখাতে পারবে না, ছবি তোলো, কিন্তু ‘শেয়ার’ করতে পারবে না। নিজের নিঃশ্বাস শুধু নিজেই বুক ভরে নিতে পারবে, অন্য কারোর ঘাড়ে ফেলতে পারবে না। নিজের কথা শুধু খাতা-কলমে লিখবে, বই হিসেবে ছাপবে, ইন্টারনেটে দিতে পারবে না।

এমন সাহস কারো আছে? ফোন ফেলে দিতে হবে। রাস্তার ধারে ফোন থেকে মাঝে মাঝে ফোন করতে পারো। সে যুগ তো কয়েক বছর আগেই ছিল, সবাই তো আমরা ভালই ছিলাম। চলুন না যাই আমরা মাত্র ক'টা বছর পিছিয়ে, যাই হারিয়ে। ই-হারিয়ে। ই-যুগ থেকে হারিয়ে। এই প্রযুক্তিকে বর্জন করার সাহস থাকলেই শান্তি আসতে পারে খানিকটা জীবনে।

smartphone internet service
Advertisment