Advertisment

শিল্প, গল্প দিয়ে ক্যান্সার জয় কলকাতার তৃণার

প্রত্যন্ত গ্রামের অব্যক্ত কথা বের করে আনেন তিনি, ছোটোদের মনের কথা। নদীয়া, বীরভূম, মালদহ, মেদিনীপুরে ঘুরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোটোদের আর্ট থেরাপি করেন তিনি। 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

মনের জোর ও সৃজনশীলতা নিয়ে ক্যানসার জয়ী তৃণা লাহিড়ী

অনর্গল কথা বলে চলেছেন। লাল টপ আর কালো জিন্সের চেয়েও উজ্জ্বল তাঁর মুখের হাসি। ওটা ঠিক কিসের বিচ্ছুরণ তা দূর থেকে বোঝা যায় না। মা আর মেয়ের সংসারে হাসি গল্পে ফাঁকা ফ্লোরটা যেন একাই মাতিয়ে রেখেছেন তিনি। তাঁর গল্প বলাই কাজ, সেই গল্পে হেরে যাওয়া আছে, উঠে দাঁড়ানো আছে, সর্বোপরি একাধিক হার্ডেল পেরিয়েও এগিয়ে যাওয়া আছে, স্রেফ মনের জোরে।

Advertisment

কেমোথেরাপির কটাক্ষ, বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের ধকলে শরীরটা ভেঙে গিয়েছে ঠিকই, তবে এসবের সিকিভাগও প্রভাব ফেলতে পারেনি মনে, বরং প্রত্যেকটা প্রতিকূলতা তাঁকে বজ্রকঠিন করে তুলেছে আরও। খুব ছোট্ট বয়সে হেনস্থার শিকার হওয়ার পর পেপার কাটিং শুরু। এরপর মাঝামাঝি সময়ে এসে ফের ধাক্কা ব্যক্তিগত জীবনে, সেখান থেকেই নিজের কাজ তথা নিজেকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার চেষ্টায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী, এবং প্রথম কেমোর পর প্রথম গল্পের বই প্রকাশ... এভাবেই একটার পর একটা উতরাই তাঁকে বাঁচার উৎসাহ জুগিয়েছে।

publive-image অতীব সূক্ষ্ম তাঁর পেপার কাটিং

তিনি তৃণা লাহিড়ী। তামাম বিশ্ব যাঁকে কার্টুনিস্ট হিসাবে চেনে, প্রয়াত সেই চণ্ডী লাহিড়ীর মেয়ে। "বাবা আঁকতে পারে না," এই দাবি করে বাবার কাছে আঁকতে বসার অনুরোধ স্পষ্ট নাকচ করে দিয়েছিল বছর চারের খুদে তৃণা, আঁকা শিখেছিল অন্যত্র। শিল্পীর মেয়ে হিসাবে কোনও বাড়তি সুবিধে নেবেন না বলেই শুরু করলেন অন্যভাবে পথ চলা, গানের স্কুলেও গেলেন। তবে আঁকা কিন্তু পিছু ছাড়েনি।

প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসে স্নাতক পর্যায়ের পর ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মাঝেই কলেজের ক্লাস কামাই করে মজেছেন শিল্পের নেশায়। তাঁর নেশা বলতে কাগজ কেটে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরা। কখনও ৩৭৭ ধারা খারিজ, কখনও আবার প্রকৃতির মায়া, কখনও ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকা খুদে, কখনও  আবার প্রেমের মায়াজাল। তাঁর শিল্পে দেখা মেলে সবারই।

publive-image তৃণা লাহিড়ীর কিছু কাজ

আরও পড়ুন: দিল্লি লাইভলি: প্রবাসে বাঙালি

প্রথমে এঁকে নেন, তারপর কেবল একটা পেপার কাটারের ছোঁয়া আর হাতের জাদুতেই প্রাণ পায় সে সব আঁকা। সেখানে রঙের কারিকুরি নেহাতই সামান্য, কালো কাগজই প্রাধান্য পায়। তাঁর কাজের পরিধি শেষ হয়নি, চারদিক জুড়ে যখন সিক্রেট স্যান্টার গল্প, তখন এই স্যান্টা কিন্তু খুব সন্তর্পনে পালন করে চলেছেন তাঁর দায়িত্ব। প্রত্যন্ত গ্রামের অব্যক্ত কথাগুলো বের করে আনেন তিনি, ছোটোদের মনের কথা। নদীয়া, বীরভূম, মালদহ, মেদিনীপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোটোদের আর্ট থেরাপি করেন তিনি।

publive-image এভাবেই কথা বলেন তাঁর কাজের মাধ্যমে।

ওরাও গল্প বলে, আর সেই গল্পই প্রাণ পায় তৃণা লাহিড়ীর কাগজ আর পেপার কাটারের জাদুতে। কারও জন্য চকোলেট, কারও জন্য আঁকার পেনসিল, কারও জন্য একরাশ ভরসা, এমন হরেক উপহার মজুত এই স্যান্টার ঝুলিতে। তাঁর কাজের বেশিরভাগ জুড়েই কেন প্রকৃতি আর শিশু, এ প্রশ্নের উত্তরে এল, "যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয় শিশু আর প্রকৃতিকেই, তাই সেই গল্পই বারবার বেরিয়ে এসেছে আমার প্রতিটা আঁকায়। আসলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা শিশু লুকিয়ে রয়েছে, তাকেই বের করে আনার চেষ্টা করি।"

publive-image রক কনসার্টের চিন্তা থেকে

গল্পকারের গল্প শেষ হয়নি এখনও, তাঁর লেখা নিয়ে একাধিক চলচ্চিত্র তৈরির কাজও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। গল্পের জন্য ইউনাইটেড নেশনস অ্যাওয়ার্ডের পালকও জুড়েছে তাঁর মুকুটে। ইতিমধ্যেই বিদেশের একাধিক পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন আইআইএমসি-র এর মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানে।

publive-image আরাম

বলার অপেক্ষা রাখে না, চণ্ডী লাহিড়ীর মেয়ে হওয়ার সুবাদে ছোটো থেকেই শৈল্পিক পরিবেশে সত্তর এবং আশির দশকে বড় হয়ে ওঠা। কখনও তাবড় তাবড় শিল্পীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন, কখনও সে সময়ের নামজাদা রাজনীতিবিদদের। এদিকে বছর চারেক বয়স থেকেই দূরদর্শন ভবনে যাতায়াত শুরু করেছেন বাবার হাত ধরে।

publive-image তাঁর কাজে বার বার ফুটে ওঠে শিশুরা

ওইটুকু বয়সেও পাপেট শো, ভয়েসওভার, মূকাভিনয় করেও অন্যান্য মহলে বেশ আদুরে হয়ে উঠেছিল খুদে তৃণা। সব মিলিয়ে তৃণা লাহিড়ীর কর্মকাণ্ড তাঁর বাবার আঁকা কার্টুনের মতোই বর্ণময়। বেলগাছিয়ার রাজা মণীন্দ্র রোডের বাসভবন, ড্রইং রুমের টেবিল, প্রয়াত বাবার শেষ তোলা ছবি, এলোমেলো বই-এর র‌্যাকের ধুলোরা তাঁর সঙ্গে কথা বলে নির্জনে। "বাবা আজও আছেন," এমনটাই মানেন তৃণা। শরীরের কর্কট রোগকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমস্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার এই মনের জোর সত্যিই তারিফের দাবি রাখে।

Advertisment