"আমরা কাগজ দিই না। কাগজ জোগাড় করে আবেদন করুন শিগগির, কী দরকারে এসেছেন লিখুন।" সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা, তার লাজুক মা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একটা শরীর, এরকম আরও কত মুখ বসে আছে অপেক্ষায়। রহমান ওই সারি সারি মুখের একজন। ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে দু'বার বাস বদল করে একবার ট্রেনে চেপে এসে পৌঁছেছেন আসামের কোকরাঝাড় জেলে। সঙ্গে তিন ব্যাগ বোঝাই ফল, নুন, তেল, সাবান, শাড়ি। এরপর যদি একটা কাগজের টুকরো আনতে তিন কিমি ছুটতে হয়, এ আর এমন কী! কাগজ কেন লাগবে, কেন নতুন করে আসার কারণ দেখিয়ে লিখিত আবেদন করতে হবে, তা অবশ্য পরিস্কার নয় রহমানের কাছে। সাড়ে তিন বছরে প্রতি সোমবার গারদের ওপারে কাছের মানুষের মুখটা দেখার জন্য প্রতীক্ষার ছবিটা এতটুকু পাল্টায়নি। অথচ দেখা পাওয়ার নিয়ম বদলেছে রোজ।
চাতক পাখির মতো বসে থাকা মানুষগুলো বেশির ভাগই লেখাপড়া জানেননা। ইংরেজি হরফের মধ্যে চেনেন শুধু 'D'। একটা মাত্র হরফের তাৎপর্য অনেক। 'ডুবিয়াস/ ডাউটফুল ভোটার' (সন্দেহজনক ভোটার) বোঝাতে ব্যবহৃত অক্ষর 'D'। প্রমাণিত হলেই ঠাঁই মিলবে আসামে ছড়িয়ে থাকা ডিটেনশন হোমের কোনও একটায়। রহমানের শাশুড়ির যেমন হয়েছিল, বছর তিনেক আগে।
কোকরাঝাড়, শিলচর, তেজপুর, গোয়ালপাড়া, ডিব্রুগড়, জোড়হাট, আসামের নানা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ডিটেনশন হোম। ১৯৭১-এর পর কাঁটাতার পেরিয়ে চলে এলে নিশ্চিত ঠাঁই হবে এদেরই কোনোটায়। একই ছাদের তলায় দাগী আসামীও রয়েছে, এমন কী খুনিও। 'অপরাধ'-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ফারাক থাকলেও কী যায় আসে তাতে? ওদের সবার ঠিকানা এক।
ডিটেনশন হোমের ছবিটা একাধিকবার ঘুরে দেখেছেন সুশীল সমাজ। 'মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ভীষণ রকম', এই তাঁদের মত। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে স্বাধীন রিপোর্ট দেওয়ার কাজ শুরু হলেও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। কোকরাঝাড় জেলের কয়েদিদের পরিসংখ্যান বলছে, ৪১৭ জনের মধ্যে ১৪৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক 'ঘোষিত বিদেশি'। ১৩ জন শিশুও আছে 'ঘোষিত বিদেশি'র তালিকায়।
আড়াই ঘণ্টার দীর্ঘ অপেক্ষার পর রহমানের ডাক এল, গারদের ওপারে শাশুড়ি খাতুন। জামাইকে দেখামাত্র কেঁদে চেচিয়ে ওঠেন বাবা কাফির উদ্দিনের নাম ধরে, ১৯৬৬-এর ভোটার তালিকায় বাবার নাম ছিল। প্রতি সোমবার ছবিটা একই থাকে। রহমান একাই আসেন খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে। স্ত্রী আসেন না ভয়ে, পাছে তাঁকেও ধরে নিয়ে গারদে পুরে দেয় রাষ্ট্র। খাতুন কোকরাঝাড়ে, স্বামী আয়ুব তেজপুরে। দুজনের ঠিকানা বদলেছে বছর তিনেক আগেই। মাঝে সেতু বলতে ওই এক রহমান। সুখ দুঃখের বোধগুলো পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগে লোহার গরাদের ওপাশ থেকে এখনও রহমানের হাতে আসে হাতে বোনা পশমের মাফলার, জেলখানায় বন্দি খাতুনের তৈরি।
আয়ুবের সঙ্গেও দেখা হয় রহমানের। বলার মতো কথা ফুরিয়ে গেছে তাঁর। নথি-মামলা-আইনজীবী-পয়সা শুধু এই শব্দগুলোই চেনা লাগে আজকাল। হঠাৎ নতুন করে মনে পড়ে যায় দুএকটা নাম। এবার যেমন পড়েছে, 'রূপরাম'। বারবার রহমানকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, স্কুল শিক্ষক রূপরামের কাছে গেলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে স্কুলের সব সার্টিফিকেট। সরকারকে হয়তো এতদিন পর প্রমাণ দেওয়া যাবে, আয়ুবের দু হাতের দশ আঙ্গুলে লেগে আছে এ দেশেরই মাটি। আবারও আশায় বুক বাঁধেন আয়ুব। যদিও বাস্তবটা এখন পরিষ্কার রহমানের কাছে।