কাশফুল আর নীল আকাশে পেঁজা মেঘের ভেলা, এ দৃশ্য চোখে পড়লেই বাঁকুড়ার হাড়মাসড়া গ্রাম আনন্দে মেতে উঠত। ঘরের মেয়ে আসবে বলে কথা! আনন্দ তো হবেই। শুধু তো ঘরের মেয়ে নয়, সঙ্গে জামাই বাবাজি আর ছেলেপুলেরা, সে এক হইহই ব্যাপার হত। বছরে ওই একবার ঘরের মেয়ে জামাই আসবে, কাজেই জাঁকজমকের বিন্দুমাত্র খামতি থাকত না। মেলা বসত, সাঁওতালরা নাচগানের আসরে মাতিয়ে দিত সন্ধ্যে। সময়ের চোরাস্রোতে সেসব আনন্দের রং পাল্টেছে। তবু আজও যখন ঘরের মেয়ে ভগবতী তাঁর স্বামী আর ছেলেপুলেদের নিয়ে কৈলাশ ছেড়ে বাঁকুড়ার হাড়মাসড়া গ্রামের রায়বাড়িতে আসেন, তখন রায়বাড়ির অন্দরমহল গুনগুন করে ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ গানে। প্রায় ৩০০ বছরের এই প্রাচীন পুজো আজও বাঁকুড়াবাসীর চোখের মণি।
মা ভগবতী হিসেবেই বাঁকুড়ার হাড়মাসড়া গ্রামের রায়বাড়িতে পূজিতা হন দুর্গা। এ বছর ২৮০ বছরে পা দিচ্ছে এই পুজো। কেন মা ভগবতীর পুজো হয় এখানে? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে এ ব্যাপারে এক কাহিনী শোনালেন রায়বাড়ির সদস্য সুপ্রতীক রায়। তিনি বললেন, "আমাদের পূর্বপুরুষ ধর্মরাজ রায় এই পুজো শুরু করেন। কথিত আছে, মা ভগবতী ওঁকে স্বপ্নে ধরা দেন। স্বপ্নে মা ভগবতী জানান যে, উনি একটা মামলায় জিতবেন। এরপর উনি মামলা জেতেন। তারপরই উনি মা ভগবতীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই ভগবতী আমাদের কুলদেবতা।" কুলদেবতা হলেও দুর্গাপুজো শুরু হয় তারও কিছুটা পরে। এ ব্যাপারে সুপ্রতীকবাবু বলেন, "সেসময় গ্রামে উৎসব বলে কিছু হত না। এলাকাটা সাঁওতাল অধ্যুষিত ছিল। আনন্দোৎসব হিসেবেই দুর্গাপুজো শুরু করা হয়।"
বাঁকুড়ার এই পুজোয় কিন্তু মা দুর্গাকে অসুরদলনী রূপে দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে সুপ্রতীকবাবু বলেন, "পুজোটা বৈষ্ণব মতে হয়। মা দুর্গা বাড়ির মেয়ে, বাপের বাড়ি এসেছে, এভাবেই পুজো করা হয়। মা ভগবতীর সঙ্গে পুজো করা হয় শিব আর লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশের।"
আরও পড়ুন: কোথাও টাইম মেশিন, কোথাও আস্ত লাইব্রেরি, পুজোয় চমক তিলোত্তমার
বাড়ির পুজো মানেই আলাদা রীতি। একেক বাড়ির পুজোয় একেকরকমের নিয়মকানুন। বাঁকুড়ার রায়বাড়ির পুজোয় কি রীতি? সুপ্রতীকবাবু জানালেন, "সপ্তমীর দিন পালকিতে করে কলাবউ আনা হয়। নতুন বউকে যেমন আগেকার দিনে পালকিতে করে আনা হত, সেভাবেই কলাবউকে আনা হয়। বাড়ির ছেলেরা পালকি নেন। কলাবউকে স্নান করিয়ে আনা হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে চালকুমড়ো এবং আখ বলি দেওয়া হয়। এছাড়া পুজোর দিনগুলোতে চিড়ে ও মিষ্টি ভোগ দেওয়া হয়। সপ্তমীতে ব্রাহ্মণ ভোজন করানো হয়। দশমীতে মাকে ভোগ হিসেবে পোড়া মাছ দেওয়া হয়।" এছাড়াও পঞ্চমীর দিন থেকে নহবত বাজে রায়বাড়িতে। সানাইয়ের সুরে ঢাকের বাদ্যির মিশেলে এক অন্যরকম আবহ তৈরি হয় ঠাকুরদালানে।
রায়বাড়ির কুলদেবতা মা ভগবতী পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তি ছাড়াও শারদোৎসবের সময় আলাদা করে মায়ের মূর্তি গড়া হয়। মা ভগবতী, শিব, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশের মূর্তি বানানো হয়। প্রায় দেড়শো বছর ধরে রায়বাড়ির মূর্তি গড়ার কাজে যুক্ত রয়েছেন দিলীপ কুমার চাঁদ ও তাঁর পরিবার। মহালয়ায় দেবীপক্ষের শুভলগ্নে ভগবতীর চক্ষুদান হয়।
আরও পড়ুন: প্রথমবার ফুটপাথের খুদেদের দুর্গাপুজো দেখবে এ শহর
বাড়ির পুজোর কথা বলতে গিয়ে সুপ্রতীকবাবু স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটলেন। বললেন, "আগে তো নবমীর দিন সাঁওতালরা আসতেন, নাচগানের আসর বসত। তাছাড়া এখানে পুজো ঘিরে মেলা বসত। সেসব এখন আর হয় না। এখনও সাঁওতালরা আসেন, কিন্তু খুব কম।" রায়বাড়ির পুজোয় জাঁকজমক যে ক্রমশ ফিকে হচ্ছে, তা স্পষ্ট। সুপ্রতীকবাবু বললেন, "আমাদের প্রতিবছর পুজোর দায়িত্ব পালা করে পড়ে। এবার পুজোর পালা ক্ষীরোদ কুমার রায়, শিবশঙ্কর কুমার রায়, গৌরী রায়দের বাড়ির লোকেদের। তবে এখন অনেকেই বাইরে কর্মরত, কেউ বিদেশে থাকেন, সকলে পুজোর সময় আসতে পারেন না। পুজোটা যাতে চালিয়ে যাওয়া যায়, সেজন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দিনে ট্রাস্ট করার কথা ভাবা হচ্ছে।"
পুরনো জাঁকজমক নেই, জৌলুস অনেকটাই ফিকে, তবু আভিজাত্য রয়েছে। রাজ্যের পুরনো বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম রায়বাড়ি। আর পুজোর সময়, থিমের বাড়বাড়ন্ত দূরে সরিয়ে একটু যদি অন্যরকম স্বাদ পেতে চান, তাহলে চলে যান রায়বাড়ির পুজোয়। বাঁকুড়া স্টেশন থেকে বাস-ট্যাক্সিতে করে সোজা পৌঁছে যাবেন মা ভগবতীর পুজোয়।