বরাবরই শক্তি আরাধনার ক্ষেত্র এই বাংলা। এখানে মহাশক্তি দেবী কালী রূপে বিরাজমান। তবে, স্থানভেদে দেবীর নাম বিভিন্ন। আবার এই বাংলাই দুর্গা আরাধনায় সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব হল দুর্গোৎসব। তবে, সেটা বছরে কয়েকদিনের জন্য। এই বাংলায় এমনও বাড়ি বা মন্দির রয়েছে, যেখানে নিত্যদিন দুর্গার পূজা হয়। আর, সেই সব বাড়ি বা মন্দিরগুলোর বিগ্রহ অত্যন্ত জাগ্রত।
এমনই এক দুর্গা মন্দির রয়েছে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে। যা মৃন্ময়ী মন্দির নামেও পরিচিত। কথিত আছে, মল্লরাজ শ্রীমন্ত জগৎমল্লদেব বন-বিষ্ণুপুরের গভীর অরণ্যে দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। সেই স্বপ্নাদেশমতোই তাঁর রাজধানী তিনি প্রদ্যুম্নপুর থেকে বন বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেন। এরপর ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে, রাজবাড়ির কাছেই রাজা জগৎমল্লদেব প্রতিষ্ঠা করেন মৃন্ময়ী দুর্গা মন্দির। দেবীর মূল বিগ্রহের মুখ ও অবয়ব গঙ্গার মাটি দিয়ে তৈরি।
পণ্ডিতরা এই পুজোকে বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো বলে মনে করেন। এই পুজোর আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত দুর্গাপুজোর আচার-অনুষ্ঠান থেকে অনেকটাই আলাদা। পরবর্তীতে ঘট স্থাপন করে এখানে পটে আঁকা দুর্গার পুজো শুরু হয়। কোনও মূর্তি বিসর্জন হয় না। জিতাষ্টমী তিথির পরদিন ঘট স্থাপন করে পাশের ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুরের রাজমহল থেকে রুপোর পাত দিয়ে তৈরি মহিষাসুরমর্দিনীকে আনা হয়। সেই মূর্তিকে বলা হয় বড়ঠাকুরানি। এরপর বড়ঠাকুরানিকে কৃষ্ণবাঁধে নবপত্রিকা-সহ স্নান করিয়ে বোধনের মাধ্যমে দুর্গাপুজো শুরু হয়।
আরও পড়ুন- জাগ্রত দুর্গা, প্রার্থনা করলে মেলে সফলতা, নিত্যপুজো হয় কুমোরটুলির ঢাকেশ্বরী মন্দিরে
মানচতুর্থীর পরের দিন আবার লালরঙের কাপড়-সহ দেবীঘট মেজঠাকুরানির জল গোপালসায়ত থেকে ভরে আনা হয়। মহাষষ্ঠীর দিন বিষ্ণুপুরের রাজা ও রানিকে দেবীপট বা ছোটঠাকুরানির দর্শন করানো হয়। সেদিনই শ্যামকুণ্ডের জলে দেবীপটকে স্নান করিয়ে বেলপাতা-সহ বোধন করা হয়। জিতাষ্টমী থেকে মহাষষ্ঠী পর্যন্ত চলে খিচুড়িভোগ। মহাষষ্ঠী থেকে মহানবমী পর্যন্ত চলে বাদশাভোগ ভাত ও নিরামিষ পদ দিয়ে ভোগ।
আগে এখানে কামান দেগে সন্ধিপুজো ও পশুবলি শুরু হত। সন্ধিপুজো চব্বিশ মিনিটের মধ্যে শেষ করা হয়। মহানবমীর শেষ রাতে মহামারীর পুজো হয়। এককালে কলেরার মড়কে মল্লভূম রাজ্যের ও রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যের মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই মহামারীর পুজো চলছে। দু'জন পুরোহিত রাজপরিবারের একজন সদস্যের উপস্থিতিতে দেবীঘটের দিকে পিছন ফিরে খচ্চর বাহিনীর পুজো করেন। পাঁচ পোয়া করে বাদশাভোগ চাল, মুগ ডাল, ঘি, কাঁচকলা ও সৌন্ধব লবণ দিয়ে রান্না করা বিশেষ ভোগ সুর্যোদয়ের আগেই রাজপরিবারের সদস্যদের খেয়ে নিতে হয়।