পূর্ব কলকাতার এই বনেদি পরিবারে বাড়ির মেঝেতে এখনও ঝলমল করছে দুর্গাপুজায় দেওয়া আলপনা। এখনও দেওয়ালে স্পষ্ট হয়ে আছে সদ্য আঁকা মাঙ্গলিক চিহ্ন। সদ্যসমাপ্ত দুর্গোৎসবের রেশ কাটার আগেই আবার ব্যস্ততা আরেক ঘরের মেয়েকে ঘরে আনার - এবার উদ্যোগ জগদ্ধাত্রী পুজোর।
বেলেঘাটার বসু পরিবারের 'বনেদি' হয়ে ওঠার ইতিহাসটা অবশ্য খুবই সাধারণ, কিন্তু ১৮৫৫ সাল থেকে শুরু হওয়া জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিবৃত্তটা চমকে ওঠার মতন, যে ইতিবৃত্তের সঙ্গে ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছে সহিষ্ণুতা এবং উদারতা। এ কাহিনি শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের মধ্যভাগে, যখন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘড়িয়া গ্রাম থেকে চণ্ডীচরণ বসু আড়তদারের ব্যবসা করতে হাজির হয়েছিলেন মারাঠা ডিচের পাশে। সেসময় মারাঠা খালের নাব্যতা এতটাই ছিল যে, পূর্ববাংলা থেকে নিয়মিত পণ্য পরিবাহিত হয়ে তা জমা হতো কলকাতার উপকন্ঠে। সেখানেই দীর্ঘ পরিশ্রম ও ব্যবসায়িক বুদ্ধির জোর গ্রামের ছেলে চণ্ডী বসুকে অর্থবান করে তোলে।
তখনও কোম্পানির শাসন - লন্ডনের মহারানি সরাসরি ভারতের ভাগ্যবিধাতা নন। সুযোগ বুঝে সদ্য বড়লোক হওয়া চণ্ডী কোনও এক বড় জমিদারের থেকে ইজারায় নিলেন বিস্তীর্ণ জলাভূমি অঞ্চল, যা আমরা আজ পূর্ব কলকাতার জলাভূমি (East Kolkata Wetlands) নামে জানি। এখানেই একটা ছোটখাটো শিল্পবিপ্লব ঘটালেন তিনি। স্থানীয় কৃষক বলরাম দলুইয়ের সহযোগিতায় তিনি প্রথম শুরু করেন বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে মাঠচাষ। আজ পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে গড়ে ওঠা অসংখ্য মাছের ভেড়ি আসলে সেদিনের চণ্ডী বসুরই উদ্যোগের ফসল।
ঘরে লক্ষ্মীর আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মারাঠা খালের ধারে একদা কাঠের ব্যবসা করতেন তার কাছাকাছি বেলেঘাটার শুঁড়ার চড়কডাঙ্গায় বিশাল জমি কিনে নেন। এরই সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে শুরু করেন জগদ্ধাত্রীর আরাধনা। সেটা ১৮৫৫ সাল - ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে তখনও বছর তিনেক দেরি।
পঁচিশ বছর পর যখন পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি তুঙ্গে, অর্থাৎ ১৮৮০ সালে, জগদ্ধাত্রী এবং দুর্গা, দুটি পুজোই স্থানান্তরিত হয় বেলেঘাটায়। ইতিহাস যতদূর জানা যায় তা এইরকম, বেলেঘাটার সবথেকে বিখ্যাত দুটি বনেদি পরিবার, নস্কর ও সরকাররা তখনও শুরু করেননি তাঁদের পারিবারিক পুজো। সেই অর্থে বেলেঘাটার বসু পরিবারের জগদ্ধাত্রী পুজো পূর্ব কলকাতার প্রাচীনতম।
ছিয়াশি বছরের অশোক কুমার বসু আজও খুশিতে ডগমগ করে ওঠেন এ বাড়ির আর এই জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস বলতে শুরু করলে। এলাকার স্বনামধন্য ডাক্তারবাবু অশোক বসুর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল নিজের হাতে নিজের বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসুকে চায়ের কাপ হাতে তুলে দেওয়ার দিনটা। "আমাদের বাড়ির পাশের দুর্গা মণ্ডপে আমি সুভাষবাবুকে আবির মেখে হোলি খেলতেও দেখেছি - যদিও সালটা আর মনে পড়ে না," আবেগের সঙ্গে বলে ওঠেন বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু।
তিরিশের দশকের শুরু থেকে কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে পরিবারের। সেসময় বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন বসুদের পারিবারিক চিকিৎসক। পরিবারের এক সন্তান, নাম মনীন্দ্রনাথ বসু, অবশ্য বিখ্য়াত ছিলেন অন্য় কারণে। কলকাতার সমস্ত বিলাসবহুল পার্টিতে তাঁর মুখটি ছিল অতি পরিচিত - মানে পাক্কা পেজ থ্রি মেটিরিয়াল আর কী! যদিও এই মানুষটি ছিলেন ওস্তাদ ক্রিকেট খেলোয়াড়। কলকাতা টাউন ক্লাবের হয়ে লাহোর পর্যন্ত গেছেন ক্রিকেট খেলতে।
সময়ের সঙ্গে বেলেঘাটা অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে ভাগ হয়ে যায় বসু পরিবার, এবং জগদ্ধাত্রী পুজো বছর মেনে মেনে ফিরে আসে একেক বাড়িতে, কয়েক বছরের ব্যবধানে। "আমাদের পুজোয় বরাবরই সর্বমতের সহজ সহাবস্থান," বলেন বিক্রম বসু, এই বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম, যিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে ছুটিতে এসেছেন এবারের পুজোয়।
বাস্তবিক, বসু পরিবার কোন ধর্মীয় অন্ধকারে বেঁধে রাখেননি তাঁদের উৎসবকে। বাড়িতে আসা শেখ সামিরুদ্দিন শোনালেন এক আশ্চর্য কাহিনি। বত্রিশ বছর আগে এই বাড়িতে কাজ করতেন তাঁর বাবা, শেখ মজফফর আলি। একদিন পুজোর রাতে দেবীমূর্তির সঙ্গে একই ঘরে রাত্রিযাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী শেফালিকা বসু। পুজোর ঘরে মুসলমানের রাত্রিবাসে আপত্তি ছিল অনেকেরই, কিন্তু কোন কথায় কর্ণপাত করেননি বসু পরিবারের সেই অন্তঃপুরিকা। "জগদ্ধাত্রীর সেই রূপ আর আমি কোথায় পাব?" বলেন মধ্যবয়সী সামিরুদ্দিন।
১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার দিনগুলিতে বসুবাড়ির প্রত্যেক মুসলিম কর্মচারীকে একটি করে হিন্দু নাম দেওয়া হয়, এবং দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী পুজোর দিনগুলিতে মিশিয়ে দেওয়া হয় অন্যান্য আত্মীয়-বন্ধুদের মাঝে। "আমাদের বাড়ির ছুতোর মিস্ত্রি খগেনবাবুর আসল নাম যে খালেক, তা আমি জেনেছি অনেক পরে," বলেন বিক্রম, যিনি পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী।
এবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোয় মিশে আছে আরেকটি বৈপ্লবিক প্রথা। সব পুজোর যাবতীয় মঙ্গলানুষ্ঠানে, সব বয়সের সব মহিলাদের অবাধ অংশগ্রহণ। নবপত্রিকা স্নান থেকে বিজয়ার সিঁদুর খেলা। সবেতেই সধবা বিধবা কুমারী, সব মহিলার সমমর্যাদায় উপস্থিতি। আরও আছে - যেহেতু একদা মাছের ব্যবসা করেই চরম শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল এই পরিবারের, সেহেতু আজও এই দেবীকে প্রসাদ রূপে নিবেদন করা হয় মাছ। 'বৃহৎ নান্দিকেশ্বর' মতে অনুষ্ঠিত এই পুজায় অবশ্য বহুদিন বাদ গিয়েছে মহিষ বলি। "যে উৎসব সম্প্রীতি আর যোগাযোগের, সেখানে রক্ত থাকতে পারে না," সোজা কথা ডাক্তারবাবুর।
চণ্ডী বসুর নামে আজও একটা গলি আছে বেলেঘাটায়। যদিও সেই গলির কোনও বাসিন্দার জানা নেই এই সাধারণ মানুষটি কী অসাধারণ কাজ করেছিলেন একদিন। জানা নেই বসু পরিবারের দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস। তবে বিক্রম খুব আশাবাদী যে, দেরিতে হলেও নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। এই বিশাল পরিবারের সদস্যরা, যাঁরা সারা দেশে ছড়িয়ে আছেন, তাঁরা অনেকেই আজ সব কাজ ফেলে ছুটে আসছেন পুরনো বাড়ির উৎসবে। "এটা আর যাই হোক, কোনও ফ্যালনা জিনিস না," নিজের আধুনিক মোবাইল ফোনে এবারের অর্ধসমাপ্ত জগদ্ধাত্রীর ছবিটা দেখিয়ে হেসে ওঠেন বছর পঞ্চাশের বিক্রম।