আসামের নওগাঁ জেলায় এক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ৩৯ বছরের মহম্মদ করিমের মনে পড়ে, সেই স্রোতে ভেসে গিয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি। তখন করিমের বয়স ন'বছর। ধান চাষ করা পরিবারটি হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তুলে নিয়ে ফুঁসতে থাকা ব্রহ্মপুত্রের জল এড়িয়ে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে অবস্থিত রেল স্টেশনে।
"জলের অভিজ্ঞতা আছে আমাদের," একটু হেসে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলেন তিনি। করিম এবং তাঁর অসমিয়া সহকর্মীরা এই অভিজ্ঞতার জোরেই কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলেন কেরালার সাম্প্রতিক বন্যায়, যখন পেরিয়ার নদীর জল গ্রাস করে নিল পেরুম্বাভুর শহরে তাঁদের থাকার জায়গা, কাজের জায়গা, সব। এরনাকুলাম জেলার এই শহর, যা কার্যত কেরালার অভিবাসী শ্রমিকদের প্রাণকেন্দ্র, আজ অনেকটাই ফাঁকা। সেখানকার এক লাখেরও বেশি শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই বন্যা বিধ্বস্ত কেরালা ছেড়ে ঘরমুখো।
স্থানীয় তালুক অফিসের এক আধিকারিক বলেন, "শুধু এই শহরেই একটি ত্রাণ শিবিরে প্রায় ২,৬০০ জন শ্রমিক ছিলেন। জল নেমে যাওয়ার পর, এবং ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হওয়াতে আমাদের ধারণা অনেকেই বাড়ি ফিরে গেছেন। প্রচুর কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে কাজকর্মের অভাব। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কয়েক সপ্তাহ লাগবে।"
আলুভা থেকে পেরুম্বাভুর যাওয়ার পথে দেখা যায় অজস্র প্লাইউডের কারখানা, ইটভাটা, পাথর ভাঙার কল, চালের মিল। এই সমস্ত কারখানায় কাজ করতেন হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক, এবং জেলার এই অঞ্চলটিতেই বন্যায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এলাকার বিভিন্ন ছোটোখাটো কলকারখানার মালিকদের শিরে সংক্রান্তি, আগামী বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে নিজেদের ব্যবসা আবার দাঁড় করাতে হবে। এখনও যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার হিসেবই হয়ে ওঠে নি।
আরও পড়ুন: বন্যা বিপর্যয় কাটিয়ে ফের বিমান নামল কোচিতে
স্বাভাবিকভাবেই এই মুহূর্তে অভিবাসী শ্রমিকদের কোন জায়গা নেই। করিম, যিনি ১৭ বছর আগে ট্রেন ধরে কেরালা এসেছিলেন পেটের দায়ে, বন্যার আগে পর্যন্ত পেরুম্বাভুরের এক কাঠের কারখানায় ৪০ জন শ্রমিকের একটি দলের তত্ত্বাবধান করতেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই আসামের নাগরিক। বন্যার জল বাড়তে শুরু করা মাত্র করিম তাঁর অধস্তনদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সমস্ত আবশ্যকীয় যন্ত্রপাতি যেন অন্তত পাঁচ ফুটের বেশি উচ্চতায় তুলে দেওয়া হয়। তারপর তাঁরা ফিরে যান তাঁদের ছোট্ট খুপরি বাসস্থানে, যা সামান্য কিছু জিনিসপত্র ছিল তাই গুছিয়ে নিতে।
"জল উঠে এসেছিল গলা পর্যন্ত, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা কজন হাত ধরাধরি করে হেঁটে মেইন রোডে পৌঁছলাম। কারখানার মালিক একটি গাড়ির বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন আমাদের কাছের আরেকটি কারখানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেখানে জল ওঠেনি। ওভাবেই পালাই আমরা," বলেন করিম।
তিনি এবং আরও ৪০ জন শ্রমিক চারদিন ছিলেন সেই কারখানায়, যেখানে তাঁদের খাদ্য, জল, এবং নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দেওয়া হয় মালিকপক্ষের তরফে। বন্যার জল নামার পর নিজেদের কারখানায় ফিরে যে ধ্বংসলীলা তাঁরা প্রত্যক্ষ করেন, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। কুড়ি ফুট উঁচু কারখানার ছাদ পর্যন্ত জল উঠে এসেছিল, কাজেই পাঁচ ফুটের উচ্চতায় তুলে রাখা মেশিন যে রক্ষা পায় নি, বলা বাহুল্য। তিন ট্রাক ভর্তি টিম্বার ভেসে চলে গিয়েছে, লাখ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। কোম্পানির ম্যানেজার আশরফের কথায়, "ক্ষতির পরিমাণ অন্তত এক কোটি টাকা। কিভাবে এগোব বুঝতে পারছি না।"
করিমের দলের প্রায় দশজন কর্মী, যাঁদের বাড়ি আসাম এবং উড়িষ্যায়, আপাতত বাড়ি ফিরে গিয়েছেন কাজের অভাবে। যাঁরা শেষ মুহূর্তে মোটা টাকা দিয়ে প্লেন বা ট্রেনের টিকিট কাটতে পারেন নি, রয়ে গিয়েছেন কারখানা মেরামত এবং সাফ সাফাইয়ের কাজে হাত লাগাতে। "কাজ না পেলে এখানে থাকা মুশকিল। বাড়ির লোকও খুব চিন্তায় রয়েছে," বলেন করিম।
ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আশরফ জানেন, কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের পরিণাম। তাই তাঁদের ত্রাণ শিবিরে না পাঠিয়ে অন্য কারখানায় রেখেছিলেন। "অভরু পোয়াল, পেরুম্বাভুর তীর্নু (এরা চলে গেলে পেরুম্বাভুর শেষ)," বলেন তিনি।
প্রায় দু কিলোমিটার দূরে, পেরুম্বাভুর শহরের কেন্দ্রস্থিত 'লাকি' সিনেমা হলে চলছে বাংলা ছবি 'ভাইজান এলো রে'। অ্যাসবেস্টসের ছাদের তলায় বসে ছবি দেখছেন আন্দাজ ৬০ জন দর্শক, আশেপাশে প্রায় ৪০০ আসন খাঁ খাঁ করছে।
হলের বাইরে দাঁড়িয়ে নদীয়া জেলার কমল সরকার একদৃষ্টে ছবির পোস্টার দেখছেন, এবং ভাবছেন টিকিট কাটবেন কী না। শেষমেশ ঠিক করলেন কাটবেন না, এই বাজারে এ'কটা টাকাও বাজে খরচ না করাই ভালো। বন্যা তাঁর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে, কারণ ঠিক ওই সময়টাতেই তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িতে বসে টিভির পর্দায় কেরালার ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে স্থির থাকতে পারেন নি।
"খুব খারাপ লেগেছিল। আমাদেরই লোক তো, খুব কষ্ট হচ্ছিল," বলেন তিনি। "কেরালা দারুণ জায়গা। আমার তো কলকাতার চেয়েও ভালো লাগে," হেসে একথা বলে হেঁটে চলে যান কমল।