মিষ্টির প্রসঙ্গ যখন চলছেই তখন শহর কলকাতার উল্লেখ তাতে থাকবে না এটা একেবারেই সম্ভব নয়। এই শহরের বিখ্যাত সব মোদকদের হাত ধরেই বাংলার বুকে এসেছে নানান মিষ্টি। তবে আজকের গল্পটা একটু আলাদা। মিষ্টি মানেই তাতে পুরুষদের প্রভাব বেশি, সে ফেলু মোদক হোক কিংবা সূর্য মোদক অথবা ভীম নাগ - পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা মিষ্টি তৈরি করবেন যেন ভাবনার অতীত। তবে এই কাজকেই মান্যতা দিয়েছেন, লহনা এবং অঙ্গনা। কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি হাব যুগলস-এর এই ভাবনা চিন্তার পিছনে ছিল উদ্যম এবং প্রচেষ্টা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সাক্ষাৎকারে ভাগ করে নিলেন লহনা।
কেমন আছেন লহনা?
ভীষণ ভাল আছি, একদম দারুণ। যদিও শহর থেকে দূরে আছি, কলকাতার কথা খুব মনে পড়ছে।
মিষ্টির সঙ্গে তোমার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, ছোটবেলার অনুভূতি যদি ভাগ করে নাও...
জন্মাবার পর থেকেই বোধহয় মিষ্টি দেখেছিলাম। শিয়ালদহর কাছেই একটি বাড়িতে আমরা থাকতাম।আর আমাদের প্রথম দোকান প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৩ সালে। সামনের বছর ১০০ হতে চলেছে। আমি ছোট থেকেই দেখেছি বাড়ির বাবা জ্যাঠাদের এর সঙ্গে জড়িত থাকতে তবে তাদের তরফেও বাড়ির মেয়ে বউদের যোগ দেওয়ার ভাবনা চিন্তা করতে দেখিনি।
এত পুরনো এই মিষ্টির ব্যবসা তোমাদের, কবে থেকে ভাবনা চিন্তা করলে, যে এবার তোমারও এদিকে নজর দেওয়া দরকার?
সত্যি বলতে গেলে, একটা সময়ের পর আমি দেশের বাইরে চলে যাই। সেখানে থাকলেও আমি মনে মনে এটা জানতাম যে এই ব্যবসাটা আমায় ধরতেই হবে। কবে সেই সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। তবে কোভিড চলাকালীন বাবা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন আমি এখানে চলে আসি, এবং সেই থেকেই সংগ্রাম শুরু।
মহিলারা মিষ্টি বানাবেন, এই আইডিয়া কীভাবে এল?
দেখ, একটু বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করলেই দেখা যাবে মেয়েরাই বেশিরভাগ বাড়িতে হেঁশেল সামলান। আমি একজন মেয়ে হয়ে যদি এই কাজে যোগ দিতে পারি তাহলে আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন কেন নয়? মেয়েদের মধ্যে বেশ কয়েকটা বৈশিষ্ট্য থাকে, এই যেমন সবাইকে খুশি করা, সকলকে ভাল রাখা...আমি ওদেরকে সঙ্গে পেয়ে সত্যিই খুশি।
তুমি নিজে মিষ্টি বানাও?
অবশ্যই বানাই! আমার নিজের এই কাজ করতে ভাল লাগে। বাকি যাঁরা রয়েছেন তাঁরা অনেকদিন ধরে যুগলস-এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে, ওনাদের সঙ্গেই বসে যাই।
কোনও প্রতিকূলতা পেয়েছ এই সময়?
পেয়েছি বলতে হ্যাঁ, বাবাকে বোঝাতে অনেক সময় লেগেছিল। একজন পুরোনো চিন্তাধারার মানুষ, তিনি একটাই ভয় পেয়েছিলেন যে মেয়েদের এই কাজে নিযুক্ত করলে, তাঁদের সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। হঠাৎ করে পুরুষদের বিশেষ করে এই কাজে মেয়েদের নিয়ে আসা আদৌ ঠিক কিনা সেই নিয়েও দোনামনায় ছিলেন তিনি। তারপর আমি ওনাকে বলি, দোকানে তো আমিও থাকব! তুমি কি তাহলে নিজের মেয়েকেও সুরক্ষা দিতে পারবে না? অনেক কষ্টে ওনাকে বোঝাই। তারপর উনি রাজি হন, এখন সব ভালভাবেই চলছে।
সুরক্ষার কথা যখন বললেই, এই রাস্তায় নিজে কতটা সুরক্ষিত তুমি বোধ কর?
এক্ষেত্রে আমি একটাই কথা বলব, পৃথিবীর প্রতিটা বাবা মায়ের নিজের ছেলেমেয়েদের সেইভাবে বড় করে তোলা দরকার। সেই শিক্ষা দেওয়া দরকার। কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, কী করলে কী হয় এগুলো শেখানো দরকার। শুধু মেয়েদের বাড়িতে বন্ধ করে রাখাটা বা তাঁদের কোনও কাজ করা থেকে বিরত রাখা উপায় নয়।
বাবার কথা বললে, মায়ের ঠিক কতটা সাপোর্ট পেয়েছিলে?
আমার মা ভীষণ ফ্রি স্পিরিট। মাকে বিয়ের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে দেখেছি। লোকের জন্য কাজ করতে দেখেছি। গরিব মানুষের হয়ে লড়তে দেখেছি। এই যে জেদ কিংবা লড়ার ক্ষমতা এটা বলতে পার মায়ের থেকেই পেয়েছি।
এখন যুগলস্ অন্য মাত্রা ছুঁয়েছে, এই নিয়ে কী বলতে চাও?
এখন প্রায় ৪টে হাব আছে আমাদের। সত্যিই ভাল লাগে যখন লোকজন আসেন আমার দোকানে। বিশেষ করে দুর্গাপুজো বা নববর্ষ বলো, আমাদের স্পেশ্যাল মিষ্টি বানানো হয়। লোকজন সেটা খাওয়ার পর প্রশংসা করেন, বেশ ভাল লাগে। এই ডিসেম্বরে কলকাতা মিষ্টি লিটারেসি ফেস্টিভ্যাল রয়েছে, সেটার জন্য প্রস্তুতি চলছে।