Advertisment

ক্যানাডায় ‘সাংস্কৃতিক বাঙালির’ স্টেজে এখন সাজ-সাজ রব!

এছাড়া আর এক প্রকার বাঙালি আছেন, যাঁরা কোনো বাঙালির সঙ্গেই মেশেন না। তাঁরা শুধু ক্যানাডিয়ান। তাঁদের বছর কয়েক বাদে দেখলে বুঝতেই পারবেন না তাঁরা বাঙালি, মায় ভারতীয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
canada bengalis

বসন্ত এসে গেছে ক্যানাডায়। দেশের রাজনৈতিক এবং আবহাওয়ার উত্তাপ দুইই পৌঁছে গেছে এখানে। বরফ গলে গেছে। শুরু হয়ে গেছে পাখির কিচিমিচি, শুকনো ডালে আবার ফুলের সমারোহ, সবুজের সমাবেশ। কে বলবে এটা ঠান্ডার দেশ? এখানে মাইনাস ৩৫ অবধি নামে? সবুজের ভান্ডার এক্কেবারে উপচে পড়ে বরফের রাজ্যের দুর্নাম ঘুচিয়ে দিয়েছে।

Advertisment

“বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা,
কারা যে ডাকিল পিছে,
বসন্ত এসে গেছে!”

যথাযথভাবে বিদেশে বাঙালিদের হৃদয়ও টলমল। তাদের ভাবের প্রেক্ষাগৃহ এখন পরিপূর্ণ।

শুরুতেই বলি, ক্যানাডায় এসেই বাঙালিদের কিন্তু এই পাঁচটা কাজ অত্যাবশ্যক এবং বাধ্যতামূলক:

১) একটা কল-সেন্টারে কাজ করা
২) গাড়ি চালানো শেখা
৩) দেনায় ডুবে একটা চকমকে বাড়ি কেনা
৪) সামারে উইকেন্ডে বারবিকিউ করা
৫) বাঙালি অনুষ্ঠানে যাওয়া

আবার বাঙালি অনুষ্ঠান তিন প্রকার:

১) ভক্তিমূলক (দুর্গাপুজো, মন্দিরে ভক্তিভরে প্রণাম করা, বিভিন্ন মন্দিরের এবং গুরুর অনুগামী হওয়া)
২) সাংস্কৃতিক (Cultural)
৩) ব্যবসায়িক আদান-প্রদান (Networking)

Imon Chakraborty মন কাড়লেন ইমন। ছবি: লেখিকা

এছাড়া আর এক প্রকার বাঙালি আছেন, যাঁরা কোনো বাঙালির সঙ্গেই মেশেন না। তাঁরা শুধু ক্যানাডিয়ান। তাঁদের বছর কয়েক বাদে দেখলে বুঝতেই পারবেন না তাঁরা বাঙালি, মায় ভারতীয়। তাঁরা সেভাবেই ভালবাসেন। দেশে যান না খুব একটা। গেলেও পাঁচতারায় থাকেন।

আমি সর্বস্তরেই ঘুরঘুর করি মাঝে মাঝে, তাও শুধু গরম পড়লে। চিন্তা করি, কোন স্তরে আমি ফিট করব। প্রায় পাঁচ মাস বরফের বোকা শান্তি চিরে মাঝে মাঝে দু-হাত তুলে “আঁ-আঁ-আঁ” করে চেঁচাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেউ যদি 911 ডেকে বসে, তাই আর চেঁচাই না।

বসন্ত এলেই ক্যানাডার রাস্তায় পায়ে হাঁটা লোক দেখা যায়। কেন না শীতকালে, বরফে, ওই স্নো-বোরখার ভিতরে কে বাঙালি, কে ভারতীয়, কে মহিলা, কে পুরুষ, কে মানুষ, কে এলিয়েন, কিছুই বোঝা যায় না, তাই আমি খুব একটা বেরোনোর চেষ্টাও করি না। গরম পড়লে একটু-আধটু রাস্তায় বেরোই। গরমকালে কানে দুল পরি। কেন না সেটা দেখা যায়। হাতে চুড়িও পরি ড্রয়ার তল্লাস করে। আর গাছের পাতা অবশেষে উঁকি-ঝুঁকি দিলে তবেই আশ্বাস পাই, যে যাক! এবার গরম পড়বে। তখন শাড়ি-টাড়ি বের করি, ধুলো ঝেড়ে পরি মাঝে মাঝে কোনো অনুষ্ঠানে। এখন এখানে ১১ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মানে এটা বসন্তকাল। গরমকালে কত তাপমাত্রা হয় সেটা তোলা থাকল। পরের লেখার জন্য।

এইরকম বসন্তের আবেশে ঘুরতে ঘুরতে শাড়ি পরে একদিন গেলাম টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার আয়োজিত তাঁদের ১৪তম বার্ষিক অনুষ্ঠানে। গ্রামবাংলার ধানক্ষেতের গন্ধে মাতাল করে আসর জমালেন বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় ইমন চক্রবর্তী, প্রথম দিনেই। ইমনের নাম শুনেছিলাম আগে, কিন্তু কিছু বেকুব বাঙালির মতন, কোনোদিন তাঁর গান শুনি নি। তাই প্রথমবারেই চমকে গেলাম তাঁর গলার ভাঁজ দেখে। খোলা গলায় কখনো বিহু, কখনো পুরুলিয়ার 'রাঙা মাটির দেশে যা...', কখনো 'বিস্তীর্ণ দুপারে...' গেয়ে দর্শকদের মাতোয়ারা করে দিলেন। আর শেষে যখন 'বন্দে মাতরম' গাইলেন, তখন আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, নিজের অজান্তেই কখন দাঁড়িয়ে উঠেছি! দেখি সারা হল দাঁড়িয়ে উঠেছে। ইমন সেই সুযোগে একবার 'জনগণমন' গেয়ে ফেললেন - অনাবাসী, অপরাধী বাঙালিদের অযথা চোখের জলে-নাকের জলে করে দিলেন।

Goutam halder দাগ কাটলেন না গৌতম হালদার। ছবি: লেখিকা

নাট্যকার গৌতম হালদার শুরুতে প্রচুর হাততালি পেলেও তাঁর একনাগাড়ে ঢাকার গ্রাম্য ভাষায় একাঙ্ক নাটক সেরকম জমল না। ধার্য সময় অতিক্রম করে ফেলে শেষমেশ কানের পোকা খেয়ে তবেই মাইক ছাড়লেন।

সবচেয়ে হতাশ করলেন রূপঙ্কর। আমি খুবই অজ্ঞ সাংবাদিক। তাঁর অনেক নাম শুনেছিলাম, যথারীতি, গানও শুনেছিলাম, না জেনেই যে এগুলো তাঁর গান। যখন জানতে পারলাম 'গভীরে যাও' তাঁর গাওয়া, খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু ক্লান্ত বেশে স্টেজে স্যুট পরে এসে, কোটটা খুলে রাখলেন এমনভাবে, যেন গান শেষ করেই প্লেন ধরে বাড়ি যেতে হবে। আহারে! একে দুদিনের পথ। তারপর না পেয়েছেন জেট-ল্যাগ কাটানোর সময়, না পেয়েছেন একটু বিশ্রাম। খাওয়া দাওয়াও হয়তো হয়নি। খুবই ক্লান্তস্বরে, গলদ্ঘর্ম হয়ে গাইলেন কয়েকটা গান। আসর ধিকধিক করল।

বিদেশে আসার পর থেকে আমার পদোন্নতি হয়েছে। এই সব স্টার গায়ক-নায়কদের সামনে থেকে বসে শোনার, দেখার সুযোগ। যেটা দেশে থাকতে কোনোদিনই হতো না, কেন না ওখানে আমি কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে এক সাধারণ মানুষ। এক পত্রিকার এক সাধারণ সাংবাদিক। এখানে আমি এনআরআই! ধরাকে সরা দেখি!

টরন্টো সংস্কৃতি সংস্থার (টিএসএস) আয়োজনে প্রত্যেক বছর বহু স্থানীয় শিল্প-কলাকুশলীরা সুযোগ পান। এবারের অনুষ্ঠানে নজর কাড়লেন টরন্টোবাসী এণাক্ষী সিনহা ও সহযোগীদের ওড়িশির সঙ্গে তামার ইলানার ফ্লামেঙ্কো, তৎসহ বাংলার সৃজন চ্যাটার্জির শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যুগলবন্দী। দারুন ভালো লাগলো পরিবেশন! তবে স্থানীয় শিল্প-কলাকুশলীদের এবং দেশ থেকে উড়িয়ে আনা স্টারদের পারিশ্রমিকের মধ্যে অনেক ফারাক, তাই বিদেশে বসবাস করা অত্যন্ত প্রতিভাশালী স্থানীয় শিল্প-কলাকুশলীরা তেমনভাবে এখানে বিখ্যাত হন না। তারা না ঘর কা, না ঘাট কা। দেশেও তেমন আমল পান না, বিদেশেও না। আবার, দেশ থেকে কিছু স্টার না আনলে দর্শকাসন ভরে না। তাই আয়োজকরাও দ্বিধাগ্রস্ত।

দেশের স্টারদের ব্যাপারই আলাদা। তাঁরা দেশেও বিখ্যাত, আবার বিদেশে ডাক পড়লে তো দেশে আরো বিখ্যাত। এই মোদীকেই ধরুন না। দেশে যত না তাঁর আমল, বিদেশে এনআরআই-দের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি আহ্লাদে আটখানা। দেশে যতই তাকে ঠেস দিন বুদ্ধিজীবিরা, বিদেশে 'হীরকের রাজা ভগবান'!

Rupankar বড় ক্লান্ত মনে হলো রূপঙ্করকে। ছবি: লেখিকা

মোদীর কথায় অবশ্য বিশেষ গিয়ে দরকার নেই। মৌচাকে ঢিল মারা হবে। “মৌচাকে মৌ যখন জমেই গেল”, থুড়ি, মোদী যখন বিশাল ভোটে জিতেই গেলেন, তখন “মৌ-চোর মনকে চুরি করেই ফেলো”। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে কি? যেদিকে জল যায় সেদিকে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ এখন, কে একটা যেন বলে গেছেন। দিদিরা, দাদারা, এবার এই মৌ-সমুদ্রে, থুড়ি, মো-সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়ার চেয়ে খড়-কুটো ধরে বেঁচে ওঠাটাই কাজের কাজ। যে আসে লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আজ এই রাবণের পালা, কার আর এক রাবণের পালা আসবে। আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষরা শুধু লাট খাবে, একবার এই খড় ধরে, আর একবার ওই কুটো ধরে।

তবে, রাবণকে আজকাল আর ‘রাবণ’ বলা যায় না। তাতেও অনেক বাধা। অনেকের মতে রাবণের চরিত্র অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। সীতাকে কব্জায় পেয়েও তাঁর গন্ডী তিনি বজায় রেখেছিলেন। আজকাল এক দল ‘রাবণ’ বলে কাউকে গালাগাল দিলে মারতে আসে, আর এক দল রাম-নাম উচ্চারণ করতে গেলে তেড়ে আসে। পুরো চচ্চড়ি পরিস্থিতি। গরুকে পুজো করলেও বিপদ, খেলেও বিপদ। কী জ্বালা! যেমন ইমনকে এখানকার দর্শক অনুরোধ করতে থাকলেন, “জয় শ্রীরাম বলুন, প্লীইইজ...জয় শ্রীরাম বলুন, প্লীইইজ।” ইমন আর বেশি বাক্যব্যয় না করে বলে দিলেন, “জয় শ্রীরাম।”

এই তো আমিও বলছি, “জয় শ্রীরাম।” তাতে হলোটা কী? তাতে কি আমি হিন্দুরাষ্ট্র সমর্থন করছি, না হিন্দু গোঁড়াবাদীদের সমর্থন করছি? অতই সহজ? ৮০০ বছর ধরে তুঘলক, খিলজি, মুঘল, ব্রিটিশ অত চেষ্টা করেও ভারতে হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করতে পারে নি, এখন কে পারবে? ‘রাম’ রাজনীতি নয়, ‘রাম’ একটি কাল্পনিক (?) চরিত্র মাত্র। তাও তাঁর চরিত্র কতটা দৃঢ়, তা নিয়ে অনেকের অনেকরকম সংশয়। এটাই সত্য।

মাঝখান থেকে বাংলায় হাওয়াই চপ্পলের কারিগরদের আজ মাথায় হাত! গেলো গেলো রবে তাঁদের ব্যবসা বিপর্যস্ত। যে বাঙালিরা তথাকথিত মাইনোরিটি-পৃষ্ঠপোষকতার বিরুদ্ধে গিয়ে ‘হাম্বা’ ছাপে ভোট দিয়েছিলেন, এখন জিতে গিয়ে হঠাৎ তাদের শিরে সংক্রান্তি! দুর্গাপুজোয় রোল, বিরিয়ানি, বাঙালির ঠেসে গো-মাংস খাওয়া, সব বন্ধ হতে চলল। মাইনোরিটিকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে বাঙালীর পেটে হাত! এই যদি বলা হয় দুর্গাপুজোয় ন’দিন সব মাংসের দোকান বন্ধ থাকবে, তখন হৈ হৈ করে ওই জয় শ্রীরামকে কীভাবে বাঙালি কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করবে তা দর্শনীয় হবে। এই যদি বাঙালিকে বলে মাছ ছাড়তে - ট্যাংরা মাছের ঝাল, মৌরলা মাছের টক, ভেটকি মাছের পাতুরি, ভাপা ইলিশ, আহা! - তখন দেখা যাবে কীভাবে রামভক্তরা গরুর ল্যাজ ধরে পিট্টান দিচ্ছেন বাংলা থেকে। রাম-গরু! না না ছিঃ। আবার সুকুমার রায়কে এখানে টানার কী দরকার?

একদিকে মাছ, গরু, শুওর (পড়ুন ইলিশ, বিফ স্টেক, পর্ক চপ), আর একদিকে নিরামিষ (পড়ুন উপোস)। কোনটা বাঙালি বেছে নেবে, সেটা জানতে পারমানবিক বৈজ্ঞানিক হওয়ার দরকার নেই। সুতরাং, ভারত উপমহাদেশে গরুর বাজার চড়বে কি না জানি না, তবে আমার ধারণা, খুব শীঘ্রই কলকাতায় বিফ কাফে আবার রমরমা ব্যবসা করবে। রমজানে কলুটোলার বিরিয়ানি আর বিফ নিহারীতে ডুবে যাবে কব্জি। বাঙালি অত বোকা না। পেট বলে কথা। ধর্ম-কর্ম-নীতি-রাজনীতি সব পরে।

bengali culture
Advertisment