Advertisment

বড়দিন, বাঙালি মুসলিম, ও ইলিশ

আমাদের মেয়ে আর ছেলের আবদারে 'ভাইনাক্টসবাউম' (ক্রিসমাস ট্রি) দিয়ে ঘর সাজাতে হয়, হরেকরকম টুনি বাতি (ক্রিসমাসের বিশেষ বাতি) ট্রি-তে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bengali muslim christmas

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

"আপনি অবিবাহিত, আপনার সন্তানাদি নেই। আমাদের এক কন্যা, এক পুত্র। কন্যার বয়স আট, পুত্রের ছয়।"

Advertisment

"বলতে চাইছেন, আপনারা বিবাহিত।"

"নিশ্চয়। মৌলবি ডেকে, সাক্ষী রেখে, তিন কবুল করে বিয়ে করেছি।"

জার্মানি-সহ ইউরোপের বহু দেশে বিয়ে না করে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে একত্রে বসবাস, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সন্তান হচ্ছে। সন্তানকে আদর-স্নেহ-দেখভালে বিবাহিত স্বামীস্ত্রীর চেয়ে বরং বেশি ভালবাসে। বিয়ে প্রায় উঠেই যাচ্ছে, বলে 'সেকেলে কালচার'। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে ৭০ ভাগের বেশি বিবাহবিচ্ছেদ, জার্মানিতে ৬০ ভাগ। আরও বাড়ছে।

গত বছর, গোটা জার্মানিতে ২,৬৭৭ নরনারীর বিয়ে, এই নিয়ে মিডিয়া খবর, ধর্মযাজকরা মহাখুশি। সমকামীদের বিয়ের সংখ্যা পরিসংখ্যানে বলা হয় নি। খোঁজ নিলে জানা যাবে নিশ্চয়। সমকামীরা বিয়ের ব্যাপারে খুব উৎসাহী নয়, একসঙ্গে থাকতেই ভালবাসে। সমকামীদের থাকা এবং বিয়ে নিয়ে কারোর মাথা খামচানি নেই। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন, স্বাধীনতা। বিয়েও এখন চাকরি, অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। বিয়েও যে কখন কর্পোরেট সংস্থার অধীনস্থ হবে, ভাবনা তরুণ-তরুণীর।

বিয়ের পর বিচ্ছেদ হলে বিচ্ছেদের খরচ দশগুণ। সন্তান মায়ের কাছে থাকলে আরও খরচ, দিতে হবে বাপকেই, যদি সামর্থ্য থাকে। বিয়ে মানেই অফিশিয়ালি স্বামীস্ত্রী, কিন্তু তার অর্থ এই নয় স্বামীর পদবী নিতে হবে স্ত্রীকে, তিনি বাধ্য নন নিতে। অধিকাংশই নেন না আজকাল। যখন পূর্ব জার্মানি ছিল, আজকের চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল যাঁকে বিয়ে করেছিলেন, সেই স্বামীর পদবী ছিল মেরকেল। বিচ্ছেদের পর আরেকজনকে বিয়ে করেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রাক্তন স্বামীর পদবী রদ করেন নি, বহাল রেখেছেন। বর্তমান স্বামীরও আপত্তি নেই।

বিবাহিত স্বামীস্ত্রী-সন্তানের কথা যখন বলছেন, আরও একটি বিষয় জেনে রাখবেন, এই বার্লিনেই, তিন বাচ্চা একত্রে দেখলে (ভিন্ন পিতামাতার), এক বাচ্চার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়নি। না হোক, এই নিয়ে কি সন্তানের মাথাব্যথা? আরও জানবেন, সন্তানের মা যদি চান, বার্থ সার্টিফিকেটে সন্তানের পিতার নাম থাকবে না, বাধ্য নয় লিখতে সোশ্যাল ডিপার্টমেন্ট। এমনকি, মা যদি না চান, তাঁর পরিচয় পর্যন্ত দিতে। নথিপত্রে অনুল্লেখিত থাকবে। বহুবছর ধরেই পাসপোর্টে বাবা-মায়ের নাম থাকে না। দরকার নেই। ব্যক্তি পরিচয়ই মূলে।

জিনাত এবং তাঁর স্বামী মকবুল কেন "আপনি অবিবাহিত, আপনার সন্তান নেই" বলেছিলেন, নানা কথায় পরিষ্কার হলো। ওঁরা সিলেটের। পীর পরিবারের। ইসলাম-অন্ত প্রাণ। জিনাত সাধারণত ঘরের বাইরে যান না। কালেভদ্রে গেলেও, বোরখা না পরলেও, হিজাবে মাথা ও দুই চোখ ঢাকেন। স্বামীর মাথায় সর্বদাই টুপি। শীতকালে 'ক্যাপ' পরেন, উলের। মকবুল এক আরবি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন, "সব খাবারই হালাল এখানে," জানান।

"আপনার সন্তান নেই, ভালো আছেন।"

"কেন?" জিজ্ঞেস করি।

জিনাত-মকবুলের কথা, 'ভাইনাক্টেন'-এ (ক্রিসমাস) স্কুলে মাত্র দুইদিন ছুটি, নববর্ষ উপলক্ষ্যে একদিন ছুটি, এই ছুটিতে কোথাও যাওয়া যায় না, দেশে যাওয়া যায় না। ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানেই থাকতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুলের ছুটি দেড়মাস, গ্রীষ্মকালে। "তখন আমাদের দেশেও প্রচণ্ড গরম, ছেলেমেয়ে যেতে চায় না। বড় বিপদে আছি।"

"কিসের বিপদ?"

"ভাইজান, সেই কথাই বলছি। মেয়ে ও ছেলে স্কুলে পড়ে (মেয়ে স্কুলে, ছেলে কিন্ডারগার্টেনে)। 'ভাইনাক্টস' উপলক্ষ্যে ২৪ তারিখ (ডিসেম্বর) স্কুল ছুটি। ওই দিন, বিকেল থেকে সন্ধ্যা, রাত আটটা-নটা পর্যন্ত, নিকোলাই (স্যান্টা ক্লজ) খ্রিস্টানদের ঘরে যায় (যে ঘরে তথা বাড়িতে শিশু ছেলেমেয়ে আছে), উপহার দেয়। ঘর নানা আলোকে সজ্জিত। এই উপলক্ষ্যে স্কুলের সহপাঠিনী/সহপাঠীরা এর-ওর বাড়িতে যায়। উপহার পায়। খাবার পায়। আমাদের মেয়ে আর ছেলের আবদারে 'ভাইনাক্টসবাউম' (ক্রিসমাস ট্রি) দিয়ে ঘর সাজাতে হয়, হরেকরকম টুনি বাতি (ক্রিসমাসের বিশেষ বাতি) ট্রি-তে। ট্রি-তে নানা ধরনের উপহার সাজানো। মেয়ে ও ছেলের বন্ধুরা আসে। ওরা যে-যার মতো গাছ থেকে উপহার খুলে নেয়। ওদের জন্য খাবারও তৈরি করতে হয়।

"আমার মেয়ে, ছেলেও বন্ধুদের (সহপাঠী/সহপাঠিনী) বাড়িতে যায়, খায়, উপহার নিয়ে আসে। আমরা সাচ্চা মুসলমান, কিন্তু ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে এসব করতেই হয়। না করলে ছেলেমেয়ে ব্যাজার। সাংঘাতিক ঘটনা। ছুটির পর ছেলেমেয়ের বন্ধুরা জানতে চায় কোন বন্ধুর বাড়িতে কে কোন উপহার পেয়েছে। সেইসব উপহার দেখায়। আমাদের মেয়ে ও ছেলেও পায়। কোন কোন বন্ধুর বাড়িতে কী খায়, কত চকোলেট উপহার পেয়েছে দেখায়, আনন্দ করে। কিন্তু ভাইজান..."

"কিন্তুটা কী?"

"আমাদের পবিত্র ইসলাম ধর্মে এসব নেই। এসব করা কি গুনাহ নয়?"

"বলতে অপারগ। তবে ইসলামের হাদিসেই আছে, 'শিশুর (অপ্রাপ্তবয়স্ক) পরিচর্যায়, আনন্দদানে, পিতামাতার কর্তব্য। শিশুর কোনও ধর্মবোধ নেই। শিশুর জগতই শৈশবের জগত, শিশুর আনন্দে পিতামাতা স্বর্গীয়, একথা সব ধর্মগুরু, বয়স্করা বলেন। ইসলামেও আছে।" শুনে জিনাত-মকবুল চুপ।

যিশু-লগ্নে 'টার্কি' খাওয়ার 'কালচার' ইউরোপের নানা দেশে। টার্কি খাওয়ার কিংবদন্তী আছে, থাক। বাংলাদেশের বাঙালিরা চড়া দামে ইলিশ মাছ কেনেন, ইলিশের নানা পদ তৈরি করে, খেয়ে, সেলিব্রেট করেন যিশু-লগ্ন। বলেন, "পদ্মার ইলিশের কাছে টার্কি? ধ্যেত!"

Advertisment