শুভ নববর্ষ! হ্যাপি নিউ ইয়ার! ১৪ এপ্রিল, ১৪২৬ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখের প্রাক্কালে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
এই দিনটির সঙ্গে আমার পরিচয় খুব অল্প বয়সে, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে। আমরা তখন থাকতাম বাংলাদেশের নিস্তরঙ্গ শহর গোপালগঞ্জে (ফরিদপুর)। আমার বাবা সেখানে সাব ডিভিশনাল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এই দিনটায় আমার এবং ভাইবোনদের নিমন্ত্রণ থাকত বিভিন্ন দোকানে এবং ব্যবসায়িক সংস্থায়। দারুণ সব মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হত আমাদের। আমার অবশ্য একটাই আক্ষেপ থাকত। আমার প্রিয় 'জিলিপি' থাকত না মিষ্টির তালিকায়, কারণ মিষ্টি হিসাবে জিলিপি নাকি ঠিক 'উচ্চ শ্রেণী'র নয়। বড়দের কাছে জেনেছিলাম, এই দিনটিতে মিষ্টিমুখের রেওয়াজ বাঙালি ঐতিহ্যের অঙ্গ। এই দিনে ব্যবসায়ীরা 'হালখাতা' বা ব্যবসায়িক হিসাবের নতুন খাতা চালু করেন। এবং নতুন খাতা চালু হওয়ার আগে ক্রেতারা মিটিয়ে দেন বিক্রেতার বকেয়া পাওনা।
আশ্চর্যের, ছুটি থাকত না দিনটায়। স্কুল-কলেজ খোলা থাকত, অফিসও। আমার মা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, পাক শাসকরা দিনটিতে উৎসব পালনের বিরোধী, কারণ এই উৎসব তাদের দৃষ্টিতে 'ইসলামিক ঐতিহ্যের' পরিপন্থী। যখন ঢাকায় চলে আসি, তখনও দেখতাম, উৎসবের সুরটা খুব নিচু তারে বাঁধা। পাক কর্তৃপক্ষ বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে দমনের চেষ্টা চালিয়েই যেত, কিন্তু অদম্য বাঙালি সত্ত্বা হাল না ছেড়ে চালিয়ে যেত প্রতিবাদও।
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত 'ছায়ানট' নামের একটি প্রথম সারির সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলা গানকে জনপ্রিয় করে তুলতে আয়োজন করা শুরু করল একাধিক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানের। মানুষের থেকে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়ে ১৯৬৭ সালের পহেলা বৈশাখ সংগঠনটি রমনা পার্কের 'বটমূল'-এ আয়োজন করল এক প্রকাশ্য সংগীতানুষ্ঠানের। ঢাকাতে বাংলা নববর্ষ পালনের সেটাই সূচনা। পাক শাসকরা স্বাভাবিকভাবেই ভাল চোখে দেখেনি এই উদ্যোগ এবং নানাভাবে চেষ্টা করেছে একে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে। কিন্তু বাঙালি সত্ত্বাকে দমনের এই চেষ্টা যত তীব্র হয়েছে, তীব্রতর হয়েছে প্রতিরোধও। এবং প্রতি বছরই নতুন বছরের অনুষ্ঠানে বাড়তে থেকেছে মানুষের ভিড়।
পাক শাসনকালে বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে যেহেতু বহু বিতর্ক হয়েছে, আমি ইতিহাস ঘেঁটে বিষয়টির উৎস সন্ধানে আগ্রহী হয়ে পড়ি। ইতিহাস বলছে, মুঘল আমলে বাংলায় চাষিদের থেকে জমি বাবদ রাজস্ব আদায় করা হত ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, যা ছিল 'লুনার ক্যালেন্ডার' (চাঁদের গতিপথ যার নিয়ন্ত্রক) অনুসৃত। কিন্তু এই 'লুনার ক্যালেন্ডার'-এর সঙ্গে প্রায়শই মিলত না 'ফসলি সন' বা 'ক্রপ সাইকল'। ফলে তুলনায় অনুর্বর মাসগুলিতে রাজস্ব দিতে অসুবিধেয় পড়তেন চাষিরা।
আকবর ছিলেন দূরদর্শী শাসক। তিনি এই সমস্যার একটি বাস্তবসম্মত সমাধান চাইলেন। চাইলেন বছরের এমন একটা সময়ে রাজস্ব আদায় করতে, যখন ক্ষেতে ফসল থাকে এবং চাষিদের কাছে যথেষ্ট অর্থ মজুত থাকে। রাজ জ্যোতিষী ফতুল্লা সিরাজি ছিলেন সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন।’ লুনার ইসলামিক ক্যালেন্ডার'-এর সঙ্গে 'সোলার বাংলা ক্যালেন্ডার'-এর সাযুজ্য রেখে আকবর সিরাজিকে বললেন এক নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে। এবং সেই নির্দেশের ফলশ্রুতিতেই তৈরি হল নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। ১৫৮৪ এডি-তে এই ক্যালেন্ডারের সূচনা করলেন আকবর। নাম দিলেন 'তারিখ-ই-ইলাহি' ('ঈশ্বরের ক্যালেন্ডার')।
ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন, সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক এই ক্যালেন্ডার চালু করেন এবং এর ভিত্তিতেই সিরাজি তাঁর 'ফসলি সন' বা 'ক্রপ ক্যালেন্ডার'-এর পত্তন করেন। অবশ্য অনেকের মতে, মুঘল আমলে বাংলার গভর্নর নবাব মুর্শিদকুলি খান এই বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করেছিলেন আকবরের রাজস্ব নীতির অনুসরণে। ভিন্নমত এখানেও আছে। অনেকে মনে করেন, যেহেতু 'বঙ্গাব্দ' বা বাংলা ক্যালেন্ডারের উল্লেখ বিভিন্ন মন্দিরে এবং নথিপত্রে পাওয়া যায় আকবরের পূর্ববর্তী আমল থেকেই, তাই আকবরের প্রাপ্য নয় এ কৃতিত্ব। আসল উৎস সে যা-ই হোক, আকবরের চালু করা বাংলা ক্যালেন্ডারই যে আজও বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের ভিত্তিভূমি, সেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
ব্রিটিশদের চালু করা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই অবশ্য এখনও বাংলাদেশের সরকারি ক্যালেন্ডার হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু 'সোলার ক্যালেন্ডার' (সূর্যের গতিপথ যার নিয়ন্ত্রক)-এর বাংলা নববর্ষের দিনটির সঙ্গে কখনও কখনও মিলত না গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের নতুন বছর। মহম্মদ শহিদুল্লাহ-র নেতৃত্বে এক উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি ১৯৬৬ সালে এই সমস্যার সমাধান করে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকেই মেনে প্রতি লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাসে একটি বাড়তি দিন যোগ করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের অন্যত্র যেখানে বাঙালিরা আছেন বেশি সংখ্যায়, সেখানে 'সোলার সাইকল' মেনে এপ্রিলের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল পালিত হয় বাংলা নববর্ষ।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলা নববর্ষ পালনের সরকারি স্বীকৃতি মেলে বাংলাদেশে। এখন দিনটিতে ছুটি থাকে, ধর্মনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ মেতে ওঠেন আনন্দে, উৎসবে। যে উৎসব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে পরিণত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, যে উৎসবে মানুষের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব আর ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটে।
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশ সাক্ষী থেকেছে বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের। গর্বের বিষয়, বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে সংস্কৃতির এই উদযাপন। যেমন ইউনেস্কোর তরফে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা। তেমনই পহেলা বৈশাখের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। এখানে একটা কথা বলার, পহেলা বৈশাখের উদযাপন কিন্তু শুধুমাত্র বঙ্গজীবনেই সীমায়িত নয়। নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমারেও বৈশাখী-উৎসব পালিত হয় ভিন্ন চেহারায়। ষাটের দশকের শেষ দিকে ফরেন সার্ভিসের প্রশিক্ষণে যখন আমি লাহোরে ছিলাম, তখন সেখানেও চমকিত হয়ে দেখেছি বৈশাখী-উৎসবের পালন। পাঞ্জাবিদের দেখেছি ঘুড়ি ওড়াতে, নারীপুরুষদের দেখেছি রঙিন পোশাকে উৎসবমুখর, মহিলাদের দেখেছি হাতে 'হেনা' লাগিয়ে বসন্তকে স্বাগত জানাতে। সেই উৎসবের আনন্দভাবনাটি কিন্তু আমাদের থেকে আদৌ আলাদা নয়।
বাংলাদেশে এটা কালবৈশাখীর সময়, শীতের জমে থাকা ধুলোময়লা ঝড়ের তোড়ে উড়ে যাওয়ার সময়। রবীন্দ্রনাথের কথার নির্যাস থেকে ধার করেই বলি, নতুন বছরে মুছে যাক পুরোনো দুঃখ-ক্লেশ, ধুয়ে যাক সব মালিন্য। স্বাগত নতুন বছর।
(লেখক ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার)