এখন তার যৌবন নেই। শরীরে নেই জোর। আদর বলতে দুয়োরাণীর যতটুকু জোটে। ওই মাসে একটা দুটো রবিবার মাল্টিপ্লেক্সে হাউসফুল শো মিস হয়ে গেলে অগত্যা নাটক দেখা। রুপোলী পর্দার তারকাকে মঞ্চে দেখলে তাও কোনোমতে ঘণ্টা দেড়েক কাটিয়ে দেওয়া। আর তা না হলে বিরতিতে ফিশ কাটলেটের পর একটু এদিক সেদিক ঘুরে 'বাঙালির সব গেছে' ধরণের প্রলাপ বকতে বকতে বাড়ি ফেরা এবং ভুলেও ও পথ না মাড়ানো, এই তো হয়ে গেছে এক রকমের অলিখিত নিয়ম। তো এরকম এক ঘোর দুঃসময়ে দল ভুলে শুধু বাংলা থিয়েটারকে ভালোবেসে, থিয়েটারের জন্য হাতে হাত রাখার কথা ভাবছেন কিছু মানুষ। উপলক্ষ্য একটা আছে বটে। এ বছর পঞ্চাশে পা দিল নাট্যদল রঙরূপ।
১৯৬৯ -এ পথ চলা শুরু রঙরূপের। শুরু করেছিলেন গৌতম মুখোপাধ্যায়। এখন দলের দায়িত্বে রয়েছেন নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়। সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এক বিশাল কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেছেন রঙরূপের সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা। শনিবারের সাংবাদিক বৈঠকে প্রকাশিত হল তারই তালিকা। আগামী ২ থেকে ৮ অক্টোবর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাঁরা। ২ তারিখ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে আয়োজন করা হয়েছে জাতীয় স্তরের এক আলোচনা সভার। ভারতীয় থিয়েটারে বর্তমান সমাজ কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, তাই নিয়ে আলোচনা। অংশ নেবেন দেশের নাট্য মহলের দিকপাল ব্যক্তিত্বরা - সতীশ আলেকর, সুধন্য দেশপান্ডে, নীলম মানসিং চৌধুরী, অমিতেশ গ্রোভার প্রমুখ। থাকছেন অঞ্জন দত্ত এবং তৃণা নীলিনা ব্যানার্জি। গোটা আলোচনা পরিচালনার দায়িত্বে থাকছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস, তপন থিয়েটার এবং মধুসূদন মঞ্চ, এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহে সাতদিনব্যাপী চলবে নাটক, শ্রুতি নাটক। আগামী ২৮ তারিখ থেকে নাটকের টিকেট পাওয়া যাবে সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাগৃহে। ১০০, ১৫০ এবং ২০০ টাকার টিকেট। থাকছে 'রক্তকল্যাণ', 'নীল রঙের ঘোড়া', 'জলছবি'-র মতো জনপ্রিয় নাটক, ‘সোনাই বিবি’র মতো নতুন প্রযোজনা। শ্রুতি নাটক 'সাঁকো'-র জন্য এই প্রথম রঙরূপের সঙ্গে কাজ করছেন 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ'-এর অশোক মুখোপাধ্যায়। "নাটক, গান, কবিতা তো আলাদা আলাদা দ্বীপের মতো থাকতে পারে না, একটা আরেকটাকে ছাড়া বাঁচতেই পারে না," জানালেন অশোকবাবু।
বাংলা নাটকের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা নিয়ে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন নাট্যকার চন্দন সেন। বললেন, "উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, শম্ভু মিত্রের পর পৃথিবী আর বাংলা থিয়েটারকে মনেই রাখেনি। বিদেশে কেউ খবর রাখেন না, বাংলা থিয়েটার এখন কোথায় দাঁড়িয়ে। তিন দশক ধরে একটু একটু করে আন্তর্জাতিক নাটকের মঞ্চে বাংলা নাটক একেবারে হারিয়ে গেল। অথচ দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি তো। বাংলার নাটককে তুলে ধরার ব্যাপারে রাষ্ট্রের মদত নেই।"
এত বড় অনুষ্ঠান আয়োজনে রাজ্য সরকারেরও সাহায্য মেলেনি, জানালেন রঙরূপের সদস্যরা। তবু না দমে একসঙ্গে পথ হাঁটার সাহস দেখালেন এখনও স্বপ্ন দেখা বাংলার কিছু মানুষ। দলের ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে, নাম ভুলে, খ্যাতি ভুলে, গ্ল্যামার ভুলে, শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার খিদে ওঁদের আরও অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে চলুক। আর আমরা দর্শকরা পাশে থাকি বাংলা নাটকের। আরেকটু বেঁধে বেঁধে থাকি?