বাঙালি মানেই খাদ্যরসিক, আর শেষ পাতে নানা রাজকীয় মিষ্টির আয়োজন। মিষ্টি একদিকে যেমন উপহার, তেমনই নানা অছিলায় সঙ্গীও বটে। এমন বাঙালি বাড়ি খুঁজে পাওয়াই দায়, যাদের ঘরে মিষ্টি নেই। অতিথি এলেও এক প্লেট মিষ্টি শোভা বর্ধন করবেই।
Advertisment
এই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মিষ্টির বাহার কিন্তু প্রচুর। জায়গা বিভেদে সেখানকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত নামকরা কিছু মিষ্টি। রসগোল্লা, পান্তুয়া ছাড়াও রসের মিষ্টি হোক কিংবা ছানার সন্দেশ - এমনই হুগলি জেলার জনাই এর মনোহরা কিন্তু বেশ বিখ্যাত। আজ্ঞে হ্যাঁ! বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল মিঠাই-এর মনোহরার কথাই বলা হচ্ছে। আর এই অনিন্দ্য সুন্দর মিষ্টি তৈরির ইতিহাসটি সত্যিই অবাক করার মতো।
মনোহরা
জনাইয়ের মিষ্টি বিক্রেতা, কমলা মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্ণধার স্বপন দাস বলেন, সে অনেক পুরনো ইতিহাস। জনাইয়ের জমিদার তখন কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন। সমৃদ্ধি ছিল শহরে। এমনই এক সময় ইংরেজ এক সাহেবের আগমনে রাজবাড়ি (কালীবাবুর বাড়ি) জুড়ে হইহই রইরই। মিষ্টি তো সবাই বানায়। তবে রসের বাঁধন থাকবে, ধাঁচ হবে শুকনো এমন মিষ্টি কোথায় পাওয়া যায়? সালটা ১৮৬৮ হবে, কালীবাবুর অনুরোধেই ন্যাড়া ময়রা বানালেন দুর্দান্ত স্বাদের এক মিষ্টি, নাম তখনও অজানা। ইংরেজ সাহেবের পাতে পড়তেই স্বাদ আস্বাদনে আর দেরি করলেন না। মিষ্টি মুখে দেওয়ার পরেই, এক্কেবারে মিলিয়ে গেল। আবেগে আপ্লুত সাহেব কাটা কাটা বাংলায় বললেন, "এই মিষ্টি আমার মন হরণ করে নিয়েছে।" ব্যস! সেই থেকে মন হরণ করা এই মিষ্টির নাম মনোহরা...
Advertisment
কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দুই সদস্য স্বপন দাস এবং তপন চট্টোপাধ্যায়
এখানেই শেষ নয়! স্বপনবাবুর আরেক সঙ্গী তথা দোকানের অন্যতম সদস্য তপন চট্টোপাধ্যায় বললেন, এই মিষ্টি এতটাই নরম একটু ধাক্কা লাগলেই ভেঙে যেতে পারে। তবে মুখে দিলেই মিষ্টির বিস্ফোরণ। দানা নেই, মুহূর্তেই মিলিয়ে যাবে। বাইরের সুগার সিরাপের আবরণ প্রথম থেকেই দেওয়া হত। এবার সেটিকে ফেলে দেবেন না খাবেন এটা মানুষের ব্যাপার। তবে বাইরে ৭/৮ দিন রেখে দিলেও এই মিষ্টি একেবারেই নষ্ট হওয়ার নয়।
প্রশ্ন একটাই, এর চাহিদা কেমন? অর্ডার ভাল পান? এককথায় মিঠাই সিরিয়ালকে বিরাট কৃতিত্ব দিলেন দুই সদস্যই! তাদের বক্তব্য, "এত জনপ্রিয় মিষ্টি শুধুই প্রচারের অভাবে পিছিয়ে ছিল। এই সিরিয়ালের পর অনেকেই জেনেছেন যে, মনোহরা নামের কোনও মিষ্টি হয় এবং এই জনাইয়ে সেটি পাওয়া যায়। এখন অনেক টিভি শো থেকে আমাদের কাছে অনুরোধ আসে। আহারে বাংলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অনেকেই আসে, মিষ্টি নিয়ে যায়। সত্যিই আনন্দ হয়।"
গুড়ের মনোহরা
কীভাবে বানানো হয় মনোহরা?
ছানা এবং চিনি এই হল আসল উপকরণ। ছানা ভাল করে মেখে নেওয়ার পরেই তাকে চিনির সঙ্গে পাক দেওয়া হয়। মেশানো হয় এলাচ, ডাবের শাসের পাতলা আস্তরণ। তারপর সেই পাক হাতে গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটিকে রূপ দান করা হয়। সবশেষে শিরায় সেটিকে মেশানো হয়। একবার কোট করেই তুলে নেওয়া হয়। মনোহরা তৈরি!
স্বপনবাবু বলেন, চারপুরুষ ধরে তাঁরা ব্যবসা করছেন, মনোহরা বানাচ্ছেন। শুধুই ছানার নয়! নলেন গুড়ের মনোহরা স্বাদে অতুলনীয়। এই স্বাদ আর কোনও দোকানে পাওয়া যাবে না। বাসি নয়, রোজের মিষ্টি তৈরি হয়।