কাইলেবাছারি, বালাম, খোরোকিস্তি, পানসি, মাসুলা, কোসা, ভেদী, পাটিয়া। নামগুলো চেনা লাগে আদৌ? নাকি একেবারে ভিনদেশি মনে হয়? অথচ আপাত-অচেনা এই নামগুলো আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল মাত্র একশো বছর আগেও।
নৌকোর নানা রকমফের এসব। প্রতিবেশী জেলাতেই এখনও এদের ব্যবহার রয়েছে হরদম। জেটগতির শহুরে জীবনে অবশ্য নৌকো-টোকো ব্রাত্য। তবু, সুজলাং বাংলার নৌকো-কথা বয়ে নিয়ে চলেছে এ শহরেরই এক সংগ্রহশালা। আজ তারই গল্প।
কালো কাঠের কারুকাজ করা মস্ত দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক অন্য জগত। সারি সারি নৌকো দিয়ে সাজানো প্রকাণ্ড এক ঘর। সত্যি নয়, বলাই বাহুল্য, সত্যির আদলে তৈরি নিখুঁত সব মডেল। দেখতে শুরু করলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই অবশ্য ভুলে যাবেন, আসল নয় একটাও, নিছকই মডেল। কাঁকুড়গাছির আম্বেদকর ভবনের বোট মিউজিয়ামের আপনাকে স্বাগত। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসর কল্যাণ এবং আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের উদ্যোগে তৎকালীন মন্ত্রী ডঃ উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস উদ্বোধন করেন এই মিউজিয়ামের। পোশাকি নাম, 'হেরিটেজ বোটস অব বেঙ্গল'।
এপার-ওপার দুই বাংলার নৌকোসম্ভারের মডেল দেখতে পাবেন এই মিউজিয়ামে। প্রতিটি মডেলের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে নৌকোর মাপ, কোথায় সেসব ব্যবহার হয় বা একসময় হতো, কতদিন আগে কী কাজে ব্যবহার করা হত, তার তথ্যপঞ্জি। একই ধরনের যাত্রীবাহী অথবা মালবাহী নৌকোর চেহারা আবার অঞ্চলবিশেষে একেক রকম। উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের নদীর নাব্যতা আলাদা হওয়ায় তাদের নির্মাণশৈলীও আলাদা। পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে তেমন ফারাক। আবার খালবিলে যে নৌকো চলে, তার সঙ্গে বিস্তর ফারাক উপকূলবর্তী অঞ্চলের নৌকোর। মাছ ধরার জন্য তৈরি নৌকো (ফিশিং বোট) আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তৈরি নৌকোর (রেসিং বোট) ধাঁচও একেবারেই আলাদা।
সংগ্রহশালা গড়ে ওঠার সময় দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন স্বরূপ ভট্টাচার্য, যিনি এখন রয়েছেন মৌলানা আজাদ মিউজিয়ামের দায়িত্বে। নিখুঁত ভাবে প্রতিটি নৌকো তৈরির পেছনে যে কারিগররা, সবাই রাজ্যের তফশিলি জাতিভুক্ত। প্রাথমিক ভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির কথা ভেবেই রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগ।
সোম থেকে শুক্র সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা মিউজিয়াম। কোনো প্রবেশমূল্য নেই। মিউজিয়াম আয়তনে যে খুব বড় তা নয়। তবে হাতে অন্ততপক্ষে ঘণ্টা দুয়েক সময় নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। যা দেখছেন, তার সঙ্গে শুধুই বিরস কিছু তথ্যের সম্পর্ক নয়। 'বাংলাদেশের হৃদয় হতে' উঠে আসা বিস্মৃতপ্রায় সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ তৈরি করতে ঘন্টাদুয়েক সময়ের হিসেবে তো নেহাতই কম।
নৌকোঘরের পরের গ্যালারিটি নকশী কাঁথার। আজকের সাজু-রূপাইদের গল্প কাঁথায় আঁকা থাকে না। তবু এই শিল্পের সঙ্গে অন্তত নতুন প্রজন্মের পরিচয়টুকু হোক, এই উদ্দেশ্য নিয়েই তৈরি হয়েছে কাঁথার গ্যালারি। আম্বেদকর ভবনের টেকনিকাল অ্যাসিস্ট্যান্ট শম্পা চন্দ বললেন, "প্রাচীন বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যেই তিন কাপড়ের এই কাঁথা তৈরির প্রচলন ছিল। অবসরে কাঁথা বোনাটা ছিল মহিলাদের বিনোদন। বিয়ের সময় মেয়ের বাড়ি থেকে পাত্রপক্ষকে যে রকম কাঁথা যৌতুক দেওয়া হত, তার গুণমানই বলে দিত মেয়ের বাড়ির অবস্থা কেমন।"
ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামগুলো আবার চর্চায় এসেছে সিনেমার দৌলতে, কিন্তু কবিগান আজ মৃতপ্রায়। হারিয়ে যাওয়ার আগে কবিগানের ইতিহাসটুকু ধরে রেখেছে নকশী কাঁথা। পুতুলনাচের ইতিকথাও সযত্নে ধরে রেখেছে এই সংগ্রহশালা। দস্তানা পুতুল, তার পুতুল, দণ্ড পুতুল...সারি সারি সাজানো রয়েছে গ্যালারিতে।
শেষ গ্যালারিটি এথনোগ্রাফিক মিউজিয়ামের। এটিই সবচেয়ে পুরনো। ১৯৫৫ সালে তৈরি। সারা রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা ১৫ টি আদিবাসী গোষ্ঠীর জনজীবন সম্পর্কে নানা তথ্য রয়েছে এখানে। এদের রোজকার জীবনে ব্যবহার্য বাসন, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, গয়না, ধর্মীয় সামগ্রী সাজানো রয়েছে পরিপাটি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির জীবনচর্যার সহজ-সরল চালচিত্রে চোখ বুলোতে বুলোতে সময় যে কখন পেরিয়ে যায়, বোঝা দায়।
গেলাম, ঘুরলাম, ছবি তুললাম আর বেরিয়ে এসে সব ভুলে গেলাম, সে গোত্রের নয় কাঁকুড়গাছিতে সিআইটি রোডের ওপর এই সংগ্রহশালা। ভাবনার খোরাক জোগায় এই বোট মিউজিয়াম, চলে আসার পরও অবচেতনে ফিরে ফিরে আসে দৃশ্যপট। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে যেমন মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়ার লাইন:
ছিপখান তিন দাঁড়
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিনভর
দেয় দূর-পাল্লা!