সেলেব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের মধ্যে ৪০ পেরোতেই দেখা দিচ্ছে হৃদরোগের নানান সমস্যা। আগে বয়স্কদের মধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে অল্প-বয়স্কদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে হৃদরোগ। হার্ট যখন নিজের থেকে রক্ত সঞ্চালন বা পাম্প করার ক্ষমতা হারায় সেই অবস্থাকেই আমরা সাধারণ ভাবে হার্ট ফেলিয়র বলতে পারি।
কোভিড প্যানডেমিক সময়ে বেড়েছে হৃদরোগের ঝুঁকি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে পোস্ট কোভিডে অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। হার্ট ফেলিয়রের আরেকটি ধরন হল যখন হৃদপিন্ডের পেশী শক্ত হয়ে যায় এবং শিথিল করতে অক্ষম হয় বিপরীতভাবে, হার্ট অ্যাটাক হয় যখন হার্টে রক্ত সরবরাহে বাধা থাকে। বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জামশেদ দালালের মতে আমাদের অনেকের মধ্যে হৃদরোগ সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা নেই। বেশ কিছু প্রচলিত ধারণা আমাদের মধ্যে রয়ে গিয়েছে যার অধিকাংশই ভুল। তিনি তুলে ধরেছেন হার্ট অ্যাটাক নিয়ে কতগুলি ভ্রান্ত ধারণা।
হার্ট ফেলিওর শুধুমাত্র বয়স্কদের প্রভাবিত করে?
ডাঃ দালাল indianexpress.com কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আগে ৫৫ পেরোনোর পরই হার্ট ফেলিওরের সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হার্ট ফেলিওরের মধ্যে ঝুঁকি ক্রমেই বেড়েই চলেছে।
হার্ট ফেলিওর অত্যন্ত আকস্মিক এর কোন লক্ষণ নেই!
এর উত্তরে ডাঃ দালাল বলেন, অনেক আগে থেকেই হার্ট ফেলিওরের ঝুঁকি টের পাওয়া যায়। সাধারণ ভাবে উপসর্গের মধ্যে থাকে শ্বাসকষ্ট, গোড়ালি এবং পেট ফুলে যাওয়া, ক্লান্তি, খিদে কমে যাওয়া।
হার্ট ফেলিওর মানেই কী জীবনের শেষ?
ডাঃ দালাল বলেন, রোগীরা প্রায়ই মনে করেন হার্ট ফেলিওর মানেই জীবন শেষ। বাস্তব কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। এখন আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীরা আবার আগের জীবনে ফিরে যেতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা পড়লে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি দেখা যায়, এটি শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে তবে তার একমাত্র উপায় হল হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশন। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, হার্ট ফেলিওরে আক্রান্ত হলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে দীর্ঘদিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব।
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট কী
কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে যখন তখন। হৃদযন্ত্রের স্পন্দনে সমস্যা হলে, অনিয়মিত হৃদ স্পন্দন হলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। একে অনেক সময় ভেন্ট্রিকিউলার ট্যাকিকার্ডিয়া অথবা ভেন্ট্রিকিউলার ফাইব্রিলেশন। সাধারণত হৃদ স্পন্দন বেড়ে গিয়েই এমনটা হয়, তবে হৃদ স্পন্দন ভীষণ ধীর গতিতে হলেও এমনটা হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, হার্ট ফেলিওর এক নয়
হঠাৎ হওয়া কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং হার্ট অ্যাটাক কিন্তু এক নয়, অনেকেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাকের পার্থক্যটা বোঝেন না, ফলে সমস্যায় পড়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে নেন রোগীর পরিবার। করোনারি আর্টারির কাজ হৃদপিন্ডে রক্ত পাঠানো, এবার কোনও কারণে একটি করোনারি আর্টারির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্টে অক্সিজেন পৌঁছায় না, এবং সেই জায়গার কোষগুলো মরে যায়। তবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ আলাদা, এ ক্ষেত্রে অ্যারিদমিয়ার কারণে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাকের আগাম উপসর্গ হয় কি?
এক্ষেত্রে অনেক সময় উপসর্গ দেখা দিতেও পারে, আবার নাও দেখা দিতে পারে। উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হলো হাঁটতে গিয়ে বুকে চাপ। অনেকেই এই ব্যথাকে গ্যাসের সমস্যা ভেবে ভুল করেন। দিনের পর দিন একই ব্যাপার চলতে থাকলে বুঝতে হবে তা খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে রাতে ঘুমের মধ্যে বুকে চাপ, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে আর ঘুম না আসা, ঘুম থেকে উঠে সকালে শরীর খারাপ লাগা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। অনেকেই এই বিষয়কে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করে থাকেন। মনে রাখতে হবে সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস ছাড়া এমন ব্যথা হয় না। কাজেই বুঝে নিতে হবে এগুলো হার্ট থেকেই হচ্ছে। এছাড়া বুক ধড়ফড়, শ্বাস নিতে সমস্যা, ক্লান্ত লাগা ইত্যাদি উপসর্গ হতে পারে।
অবিলম্বে চিকিৎসা হিসেবে কী করবেন?
যা অবিলম্বে করা দরকার, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসকিটেশন। আক্রান্তের বুকে চাপ দিতে হবে। ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর একবার করে আক্রান্তের মুখে মুখ দিয়ে হাওয়া দিতে হবে। অনেক সময় জলে খাবি খেতে খেতে অচেতন হয়ে গেলেও এভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়। মুখ দিয়ে যদি হাওয়া দিতে নাও পারেন, শুধুই বুকে চাপ দিতে থাকুন ঘনঘন।
ঝুঁকি কাদের
হার্ট বা করোনারির রক্তনালিজনিত সমস্যা থাকলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সম্ভবনা রয়েছে, এ ছাড়াও হার্টের সমস্যার পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, রক্তে বেশিমাত্রায় কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি, টাইপ টু ডায়াবেটিস, হরমোন ঘটিত সমস্যা, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ধূমপান, মদ্যপান। মূলত মধ্যবয়স্কদের ঝুঁকি বেশি হলেও বর্তমানে কমবয়সীরাও যথেষ্ট ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। হার্ট ফেলিওরের ক্ষেত্রে মহিলাদের ঝুঁকি বেশি।
নজর দিন ডায়েট এবং শরীরচর্চাতেও
শর্করা জাতীয় খাবার যেমন, চিনি, গুড়, মধু, মিষ্টি এসব বাদ দিন, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট না খাওয়াই ভাল। রেড মিট-এ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে কাজেই রেড মিট না খাওয়াই ভাল। মাংসের মেটে, মাছের ডিম ইত্যাদিতে কোলেস্টেরল থাকে কাজেই এ সমস্ত বাদ দিন খাদ্যতালিকা থেকে। ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে এমন কিছু খাবেন না। অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান ছাড়ুন আজই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফ্রিহ্যান্ড করুন। পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন।