করোনাভাইরাসের কারণে দু’বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে। একের পর এক নয়া প্রজাতির দাপটে বিপন্ন শৈশব, প্রায় দু’বছরের বেশি সময় ধরে স্কুলের গেটে তালা ঝুলছে। অনলাইন ক্লাস, আর বাড়ির একঘেয়ে পরিবেশ শিশুদের মানসিক বিকাশ অনেকাংশেই ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করছেন চিকিৎসকরা। জোরালো হচ্ছে স্কুল খোলার দাবিও।
গবেষণায় দেখা গেছে শিশুরা বাড়ি থেকে স্কুলের পরিবেশে অনেকে বেশি স্বচ্ছন্দ। সম্প্রতি শিশুদের মানসিক বিকাশের উপর করা এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, শিশুর জীবনে পরিবারের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার স্কুল জীবন। যুক্তরাজ্যে করা এক গবেষণায় এমনটাই বলা হয়েছে। গবেষণায় জড়িত গবেষকরা দেখেছেন যে স্কুলে শিশুরা নিরাপত্তা এবং সম্মানের পরিবেশ উপভোগ করেছে, তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভাল সংযোগ ছিল, সেই স্কুলের শিশুদের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা ভালো ছিল। কিছু শিশু বাড়ির নেতিবাচক পরিবেশ ইতিমধ্যে তাদের অনেক মানসিক চাপ বাড়ছে। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে শিশুদের মধ্যে।
এর মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, অনলাইন ক্লাসের কারণে শিশুদের মোবাইল এবং ইন্টানেটের প্রতি আসক্তি বাড়তে পারে। শিশুমনোরোগ বিশেষজ্ঞ তনিমা ব্যানার্জী জানিয়েছেন, এমন অনেক শিশুকে নিয়েই তাদের মা বাবারা আসছেন, যারা বলছেন যে,শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তি আসক্তি বাড়ছে। এছাড়াও সন্তানদের মধ্যে আরও অনেক আচরণগত নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করার কথা বলছেন বাবা মায়েরা।
নবনীতা রায়, চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, মাঝে মধ্যে অফিস যেতে হচ্ছে, বেশিরভাগ দিনই চলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম, স্বামী, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী। তার এক সন্তান, ক্লাস টু’তে পড়ে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সারাক্ষণই প্রায় বাড়িতে থাকছে তার সন্তান। আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের প্রতি। মনোযোগ হারাচ্ছে পড়াশুনার ক্ষেত্রেও। অনেক বেশি খিটখিটে স্বভাবের হয়ে পড়ছে সে। "সারাক্ষণই ওদের মাথায় থাকে যে কখন মোবাইলটা নিয়ে গেমস খেলতে বসবে। পড়াশুনার কথা বললে সেখানে কোন কান দেয় না।" যেটুকু সময় অনলাইন ক্লাস চলছে সেটুকু সময় ধরে বেধে পড়াতে হয়, বাকী সময়ে চলে দস্যিপনা”!
তাঁর কথায়, অবিলম্বে স্কুল খোলা দরকার, না হলে বাচ্চাদের পড়াশুনার অভ্যাসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। বিপন্ন হবে শৈশব”!
সবরকম ক্লাস কোচিং অনলাইনে হওয়ার কারণে সারাক্ষণই ঘরবন্দী, ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্রী দিশা। তার সঙ্গে কথা বলতেই তার গলায় শোনা গেল আক্ষেপের সুর, দিশা জানালো, “কতদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়না। এভাবে আর ভালো লাগছে না। কবে যে স্কুলটা খুলবে”! সারাদিন প্রায় দুবছর ধরে একঘেয়ে রুটিনে বিরক্ত হয়ে পড়েছে ছোট্ট দিশা। বাবা-মায়েরা বলছেন, শিশুরা বাড়িতে থাকলেও নিয়মতান্ত্রিক জীবনে আর অভ্যস্ত নয় তারা।
শিশুমনোরোগ বিশেষজ্ঞ তনিমা ব্যানার্জীর কথায়, ‘হঠাৎ করে জীবনযাপনের পরিবর্তন শিশুদের উপর প্রভাব ফেলে’। "অনেক সময় আমরা দেখি যে, অনেকের আচরণগত সমস্যা হচ্ছে, অনেকে প্রচণ্ড জেদ করছে, ইমোশনাল রিঅ্যাকশন হচ্ছে, কান্নাকাটি করছে কেউ কেউ, কেউ হয়তো জেদ করে কোন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যবহার বাড়ছে,"। একটু বড়রা, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছে, আইসোলেটেড হয়ে আছে, তারা তাদের রুমেই বেশি সময় কাটাচ্ছে।"
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের আচরণগত পরিবর্তন শিশুদেরকে মহামারি পরবর্তী জীবনেও তাদের খাপ-খাইয়ে নিতে অসুবিধার সৃষ্টি করবে। "বছর খানেক ধরে বাচ্চারা যদি একটা রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তারপর যদি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়, সেখানে কিন্তু তাকে খাপ-খাওয়াতে বেগ পেতে হবে, জানিয়েছেন প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল চৌধুরী।
তিনি বলেন, "এর কারণ তখন তারা একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। অনেকেই তখন স্কুলে যেতে চাইবে না, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা এবং সামাজিকীকরণেও এক ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে।" এদিকে স্কুল খোলার দাবিতে সরব হয়েছেন একাধিক সংগঠন। তাদের যুক্তি, দেশ তথা রাজ্যে সবকিছু খোলা থাকলে স্কুল খুলতে সমস্যা কোথায়”।
অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’র সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা জানিয়েছেন, “অবিলম্বেই স্কুল কলেজ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা দরকার, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিনেশনের কাজ চলছে, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওমিক্রনের প্রভাব যৎসামান্য’ তাই আর দেরি না করে স্কুল কলেজ খোলা দরকার, না হলে সমাজের কাছে এক অন্য বার্তা পৌঁছাবে”। এই একই দাবিত সরব হয়েছেন একাধিক ছাত্র সংগঠনও।