বড়দিন এসে গেছে। কলকাতা এই সময় সেজে সেজে ওঠে। সেজে ওঠে অ্যাংলো পাড়া, ভিড় বাড়তে থাকে তালতলার গলি ঘুপচির ভেতরের সার দেওয়া বেকারি গুলো। রাস্তার দু'পাশে নানা মাপের ক্রিসমাস ট্রি, সান্টা ক্লজ, জিঙ্গল বেল, এবারেও সব আছে অবিকল অন্যবারের মতো। বছর শেষের এই উৎসবের মেজাজের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিতে জাঁকিয়ে ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটেছে। এই শহরের বুকে একটু হেঁটে বেড়ালেই বেশ বোঝা যাচ্ছে তা।
বৌবাজার সংলগ্ন বো ব্যারাকের জে এন বেকারি। মালিক রতন বড়ুয়া। বললেন, "এ বছরের শুরুতেই বাড়াতে হল প্যাটিসের দাম। ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছি, বিক্রি কমেছে। কিন্তু কী করব বলুন? পেঁয়াজের দাম বেড়েছে এত। কলকাতায় আমরা প্রথম ছানার কেক বানিয়েছিলাম, ফুলিয়া থেকে মনমোহন ছানা এনে বানাই আমরা, পুরো খাঁটি ছানা। উপায় নেই বলে এটারও দাম বাড়াতে হল"। রতনবাবুর বেকারিতে আট থেকে দশ জন কর্মচারী রয়েছেন, প্রত্যেকেই মুসলমান। দেশের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে খুব স্বচ্ছ ধারণা নেই রতন বাবুর। শুধু অনিশ্চয়তা রয়েছে। ঠিক যেমন রয়েছে তাঁর দোকানের ফেজ টুপি আর সাদা দাঁড়ির মানুষটার। কথা বলছেন না, একেবারে চুপ। কেমন যেন হতভম্ব। রতন বড়ুয়া নিজের মনেই বলছেন, "কিছু হলে চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে রেখে দেব তোমাদের"। এ কথা সে কথায় জানা গেল, সে বাড়ি কখনও চোখেই দেখেননি। দেশভাগের অনেক আগেই বাবা চলে এসেছিলেন এ পাড়ে।
আরও পড়ুন, ফোন নম্বরগুলো মনে থাকে না আর, মিসড কলও আসে না
একটু দূরেই বউবাজার থানা এলাকায় আজমিরি বেকারি। দোকানের মালিক শেখ আব্দুর রহমান জানালেন অন্য বছর দোকানের সামনের রাস্তায় যানজট হয় রীতিমতো। এ বছর সে তুলনায় একেবারেই ভিড় নেই। এলাকায় সবার মধ্যে 'চাপা টেনশন' রয়েছে জানালেন। বললেন, "ধর্মের নামে আর কতদিন ভুলিয়ে রাখা হবে বলুন তো মানুষকে? সারা বিশ্বের তিনভাগের একভাগ মানুষ এখন নাস্তিক। সেখানে নতুন করে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি"? তবে আব্দুর আশাবাদী, বাংলায় নিশ্চয়ই ধর্মে ধর্মে বিভাজন হবে না। কিন্তু বাস্তবের সমস্যা আরও কঠিন। বড়দিনের মরশুমে বিক্রি এত কম কেন? আব্দুরের জবাব, "মানুষের হাতে পয়সা নেই। আগের বছর যতটুকু ছিল, ততোটুকুও নেই। লোকে খেয়ে পরে নিশ্চিন্তে থাকলে তবে তো কেকের স্বাদ নেবে, বলুন"?
আরও পড়ুন, ‘আর্মানি গির্জে’: কলকাতার প্রাচীনতম চার্চ
তালতলার লিডার বেকারি, কাজল বেকারি, কাঞ্চন বেকারির ছবিটাও আলাদা কিছু না। এখানে বড়দিনের আগ থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পা ফেলাই দায় হয় প্রতি বছর। কেক তৈরির সব উপকরণ নিয়ে এখানে চলে আসেন মানুষ। বেকারির কারিগরেরা শুধু ক্রেতাদের চাহিদা মতো সব উপকরণ সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে বেক করে দেন। লিডার বেকারির মালিক শেখ সাহাবুদ্দিন বলেই ফেললেন, "অন্যবছর এলে আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় থাকত না। এ বছর তেমন ব্যবসা হচ্ছে না দিদি"। কেন? "কারা দেশের নাগরিক, তাই নিয়ে নতুন আইন হয়েছে। সারা শহরে তার পক্ষে বিপক্ষে মিছিল হচ্ছে"। কত বছর ধরে এখানে আছেন জানতে চাইলে কিছুটা উত্তেজিত সাহাবুদ্দিন, - " আজকে থেকে নাকি, ৬৪-এর দাঙ্গার আগে থেকে আছি'। খদ্দেরদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, "দাঙ্গা দিয়ে সময়ের হিসেব রাখো!" কারিগরদের কারোর গলা এল, "দাঙ্গা যে দেখেনি, সে জানে না, সে সব ভোলার নয়"।
শীতের সন্ধে নেমে আসছিল শহরে। সময়ের আগেই বড় অন্ধকার। গির্জার ঘড়ি জানিয়ে দিল রাত তেমন গড়ায়নি। দূরের মসজিদ থেকে নমাজের শব্দ আসছে একটু একটু। কাছে পিঠে কোনও কোনও ঘরে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে উঠল। প্রতি বিকেল ফুরিয়ে এ ভাবেই সন্ধে নামে বড়ুয়াদের কলকাতায়, রহমানদের কলকাতায়।