এক অদ্ভুত অন্ধকার সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। অপরাধ বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক গুণে বেড়েছে অপরাধীর প্রতি সমাজের অসহিষ্ণুতা। চিনতে না পারা এই সমাজের জন্য সোশাল মিডিয়াকেই অনেকটা দায়ী করছেন নৃত্যশিল্পী অলোকানন্দা রায়। হ্যাঁ, কারাবন্দি জীবন থেকে উত্তরণ ঘটাতে কয়েক'শ 'আসামী'র 'মা হয়ে ওঠা অলকানন্দা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে কথা হল তাঁরই সঙ্গে।
জানালেন ম্যাডাম থেকে 'মা' হওয়ার প্রথম সুযোগ এসেছিল ২০০৭ সালে। প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের বন্দিদের নাচ শেখাতে গিয়ে গারদের জীবনকে বড় কাছ থেকে দেখা। মহিলা সংশোধনাগার তখনও তৈরি হয়নি। বললেন, "বন্দিদের নিয়ে আমি এমন একটা সময়ে কাজ শুরু করেছি, অধিকাংশই আমার সন্তানসম। প্রথম থেকেই ওদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার কোনও বাধা ছিল না। বরং কাজ করতে ভালোই লেগেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো কোনও এক সময় কোন পরিস্থিতির চাপে অপরাধ করেছে, 'অপরাধী'দের কাছে যাব না কারণ ওরা অপরাধ করেছে, এই ভাবনা আমার কোনোদিন আসেনি"।
আরও পড়ুন, সজনে শাক, অপুষ্টি এবং ভারতের সত্তর পেরনো স্বাধীনতা
ওরা যদি ভুল কিছু করে থাকে, তার শাস্তি ওরা পাচ্ছে। সাজা পাওয়ার পর তো ওদের উত্তরণ হওয়া দরকার। সেই সুযোগ টা তো সমাজকেই করে দিতে হবে। আমার কাজটাকে অনেকে কালচারাল থেরাপি বলে থাকে, আমি তো বলি লাভ থেরাপি। আমি মানুষকে ভালোবেসে তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে সমাজের মূলস্রোতে আনতে চেয়েছি মাত্র। কিন্তু ওরা যেভাবে সাড়া দিয়েছে, সেটা আমি আশাই করিনি। আজ আমি অলকানন্দা হয়েছি কিন্তু ওদেরই জন্য", বললেন শিল্পী।
সম্প্রতি কলকাতায় উদযাপিত হওয়া ৩৪ তম সর্ব ভারতীয় ডাক বিভাগের সাংস্ক্তিক উৎসবে সম্মানিত হয়েছেন শিল্পী অলকানন্দা। এ রাজ্যের মুখ্য পোস্ট মাস্টার জেনারেল শ্রী গৌতম ভট্টাচার্য জানালেন, "কারাগারে বন্দি মানুষগুলোকে কালচারাল থেরাপির মাধ্যমে জীবনের মূল স্রোতে ফেরাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অলকানন্দা রায়। ওদের জীবনের অন্য একটা মানে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টাটাকেই সম্মান জানাতে চেয়েছি আমরা"।
অপরাধ প্রবণতা যেমন বেড়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে মানুষকে 'অপরাধী' হিসেবে দেগে দেওয়ার প্রবণতা। কেন এমন দ্রুত বদলে গেল সমাজ? অলকানন্দা বললেন, "এর জন্য সোশাল মিডিয়াই অনেকটা দায়ি। এত বেশি নেতিবাচক খবর ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কিছু খবর যাচাই করে না। আর আজকে একটা গোটা সমাজ ভার্চুয়াল জগতে বাস করছে। ভাবা যায়? বন্ধু বন্ধুর সাথে মুখোমুখি বসে গল্প করে না, এর ওর ক্ষতে হাত বুলোয় না। এটা কোন সমাজ? আমার ছোটবেলায় এরকম দেখিনি তো। তখন কি চোর ধরা পড়ত না? কিন্তু, কই, সবাই মিলে চোর সন্দেহে একটা লোককে প্রাণে মেরে ফেলল, এরকম ঘটনা তো শুনিনি কখনও। আমরা কতো অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছি আজকাল"।
আরও পড়ুন, নিজের পরিবারেই আপনার সন্তান লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে না তো?
"জেলের জীবনটা হয়তো অনেক অন্ধকার। কিন্তু ওখানে সবাই অনেক বেঁধে বেঁধে থাকে, হাত ধরাধরি করে। ওরা যখন আমার কাছে নাচ তোলে, আমি দেখেছি, ওদের মধ্যে অনেক সংহতি রয়েছে, হয়তো সবরকম আধুনিক প্রযুক্তি থেকে দূরে রয়েছে বলেই ওদের একটা মন থাকে। আমার অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীর মধ্যেই আজকাল সেটা মিসিং অনেকটা। নাচের ক্লাসে সবাই না থাকলেই বা কি আসে যায়! হোয়াটসঅ্যাপে নাচ চালাচালি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি যখন সংশোধনাগারে যাই, ওদের জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখগুলো ওরা কিন্তু আমায় খুলে বলে, ভাগ করে নিতে চায় "।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এই গণতন্ত্রে আইন রয়েছে, আইনের ফাঁকতালও কম নেই। সেই ফাঁক দিয়ে একবার বেরিয়ে পড়লেই আজীবন মুক্তির স্বাদ পান কেউ কেউ। আবার কিছু 'ভুল'-এর মাশুল গুনতে অন্ধকার হাজতবাসেই কারো কেটে যায় জীবনের সবচেয়ে দামি সময়টা। তবু এই দেশে দু'একজন অলকানন্দা থেকে যান দিশাহীন মানুষগুলোকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।