কলকাতায় মা-মাসিদের হাতের রান্না না খাওয়ার দুঃখ এখন টরন্টোর বাঙালিদের ঘুচে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে এখন বেশ কয়েকটা হোম ডেলিভারি খুলতে শুরু করেছে। ধোঁকার ডালনা, এঁচোড়ের ডালনা, মোচার ঘন্ট, শুক্তো, নিম-বেগুন ভাজা, আলু পোস্ত, কলাই ডাল, ভাজা মুগ ডাল, মাছের কত কী রান্না! এতদিন শুকনো পাঁউরুটির জাবর কাটার পর মাছের ঝোলে-ডালে-অম্বলে বাঙালির পেট আবার সতেজ হয়ে উঠছে।
রান্নার একজন দেবতা আছেন না? অন্নকূট দেবতা না কী? আমরা রান্নাপুজো করি যেন কাকে? সেরকম কোনও দেবতার কাছে ভুল করে আমার পুজো পৌঁছে গেছিল কোনও এক সন্ধিক্ষণে। একবার ছেলের সঙ্গে বসে ইউটিউব দেখতে দেখতে দেখি এক সাহেব আমাদের কলকাতার ‘ভজহরি মান্না’য় বসে ইলিশ পাতুরি খাচ্ছেন। আমি দেখে বললাম, "ভ্যাট, এর থেকে ভালো পাতুরি আমি বানাতে পারি।" ছেলে বলল, "মা, তোমার একটা বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ করা উচিত। তুমি কত ভালো রান্না কর। কত বাঙালি আছে ক্যানাডায় যারা বাঙালি খাবার পায় না।" সত্যি ছিল না তখন।
আমি বললাম, "চল তো, দেখি তো খাবারের কিরকম চাহিদা।" ব্যস, যেমনি ভাবা অমনি কাজ! একটা বিনামূল্যের ওয়েবসাইট আছে, তাতে দিলাম একটা বিজ্ঞাপন। ক'দিন যেতে না যেতেই পিলপিল করে খাবারের অর্ডার! আমি তো আপ্লুত! ৪০-৫০ কিলমিটার দূর থেকে বাঙালিদের অর্ডার। "আমরা এখানে কোনও বাঙালি রেস্তোরাঁ পাই না, আপনি খুলুন না একটা," কাতর আবেদন।
আমি রান্না করতে ভালোই বাসি। তাই আগে-পিছে না ভেবে অর্ডার অনুযায়ী রান্না শুরু করে দিলাম। বেশি না, জনা পাঁচেক ছিলেন প্রথমে। বাড়িতে যা রান্না করছি, তাই একটু বেশি করে করতে শুরু করে দিলাম। সেই ৪০-৫০ কিলমিটার দূর থেকে এসে আমার ফুলকপির ডালনা, পালং-শাকের চচ্চড়ি, শুক্তো, পুঁইশাকের চচ্চড়ি, বাঁধাকপির তরকারি, গোটা পোস্তর বড়া নিয়ে গেলেন তাঁরা। আমি ভয়ে চুপটি করে বসে রইলাম প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায়। এই বুঝি বলবেন, "ইশ! কী বাজে খাবার!" "নুন কম", "ঝাল বেশি"। কিন্তু অবাক কান্ড! হইহই করে ছড়িয়ে পড়ল খবর, যে টরন্টোয় কলকাতার বাঙালি রান্না পাওয়া যায়! টরন্টো থেকে ক্যালগারি থেকে ভ্যাঙ্ক্যুভার পর্যন্ত!
আমার লেখা রইল মাথায়। বইয়ের প্রকাশনা রইল পড়ে। আমি, "আহারে! ওরা বাঙালি রান্না খেতে পায় না," বলে কোমর বেঁধে রাঁধতে শুরু করে দিলাম। একটা কোম্পানি খুলে ফেললাম। নামকরণও করলাম, 'দ্য হ্যাং-লা'। সুকুমার রায়ের 'হুঁকোমুখো হ্যাংলা'র ছবি নিয়ে একটা লোগো বানিয়ে দিল আমার ছেলে। সেটা নিয়ে ফেসবুকে একটা পেজ বানিয়ে ফেললাম রাতারাতি। কী উৎসাহ আমার বাড়িতে!
আরও পড়ুন: ক্যানাডায় মন ভরিয়ে দিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’
আরো অর্ডার আসতে লাগল বাংলা-খাবারে-বঞ্চিত বাঙালিদের কাছ থেকে। হইহই করে শুরু হয়ে গেল বাজার! এখানে বলেই রাখি, নিমপাতা, চিঁড়ে, মুড়ি, রাঁধুনি থেকে শুরু করে রুই, ভেটকি, কাতলা, লইট্যা, কাজরি, বাটা, মৌরলা, মাগুর, সব মাছই পাওয়া যায় এখানে বিভিন্ন দোকানে। বাংলাদেশি দোকানগুলোতে মাছ ভালো পাওয়া যায়, টাটকা। আর পাওয়া যায় দেশি ডাগর ডাগর পটল, নিমপাতা (শুকনো) আর রাধুঁনি (শুক্তোয় ফোড়নের জন্য)। ঝিঙ্গে, কুমড়ো, বেগুন, কাঁচকলা, সজনে ডাঁটা, মেথি শাক, পালং শাক, ডাব, কাঁঠাল, আতা, পেঁপে, কচু, উচ্ছে, করোলা, মুলো, আম, লাউ আর দারুন ঝাল লঙ্কা পাওয়া যায় চিনে বাজারে। অ্যালো ভেরা পাতা পর্যন্ত! চিনা মার্কেট হচ্ছে সব্জির স্বর্গদ্যান।
সব সাহেবরা দেখি কার্ট ভরে অ্যালো ভেরা পাতা নিয়ে যাচ্ছে। একবার না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করাতে এক মেমসাহেব বললেন, "আই টেক আউট দ্য পাল্প, মিক্স ইট উইথ ওয়াটার ইন আ মিক্সি, অ্যান্ড সিপ ইট লাইক আ ড্রিঙ্ক।" ওঁর এক দুরারোগ্য ব্যাধি নাকি সেরে গেছে তাতে।
আমার কর্তা তো এখন বাজারে এক্সপার্ট! "না না, কই মাছটা তাজমহলে ভালো।"... "ফোলা মুড়ি ডান্ডাসে।"... “এঁচোড় ইউন-মিঙ্গেই ভালো...” “চিংড়িটা লঙ্গোজে...”
বলাই বাহুল্য, তাজমহল, ইকবাল, ইউন-মিং, ডান্ডাস (মানে ভারতীয় দোকান), লঙ্গোজ, ইত্যাদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দোকান। কোনোটা ভারতীয়, কোনোটা পাকিস্তানি, কোনোটা শ্রীলঙ্কার, কোনোটা চাইনিজ, কোনোটা খোদ ক্যানাডিয়ান। ক্যানাডায় কারুর সাথে কারুর কোনও বিবাদ নেই। শুধু পেটে খাবার পড়া নিয়ে কথা। যেখানে টাটকা খাবার, সেখানেই ভিড়। সাবেক সাহেবি দোকান, যথারীতি, মেট্রো, ওশান্স্, লঙ্গোজ, ওয়াল্মার্ট আর নো ফ্রিলস্ এও আজকাল অ্যালো ভেরা পাতা রাখতে শুরু করেছে। আবার কার পাতা কত টাটকা সেটা নিয়েও রেষারেষি। লঙ্গোজে রুটি বানায়, গরম গরম।
এই হেন বিচিত্র বিদেশে বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ করার কথা ভাবাটা মোটেই উদ্ভট নয়। থানকুনি পাতার ঝোল, টাটকা কলাপাতায় মোড়া ইলিশ মাছের পাতুরি, কুচো চিংড়ির বড়া, সব বানিয়ে ফেলতে পারি। কেন যে এখনও অবধি বাঙালি রেস্তোরাঁর কথা কেউ ভাবে নি, তাই ভাবছি।
অতএব, সত্বর একটা মেনু কার্ড বানিয়ে ফেললাম। তাতে শুক্তো থেকে শুরু করে কলকাতার বিরিয়ানি পর্যন্ত রাখলাম। রুগীদের আলু-পটল-থানকুনি পাতা দিয়ে মাছের ঝোল থেকে কড়াইশুঁটির কচুরি, হিঙ্গের কচুরি অবধি। আর কচি পাঁঠার মাংস তো অনিবার্য। এছাড়া উচ্ছে পোস্ত, ঝিঙ্গে পোস্ত, আলু পোস্ত, কলাই ডাল, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল - সবই যখন টাটকা পাওয়া যায়, তো খাওয়াতে বাধা কোথায়?
আরও পড়ুন: দেশের তপ্ত কড়ায় ক্যানাডাকে একটু সেঁকে নি বরং
আমাদের ‘দ্য-হ্যাংলা’ থেকেই রান্না যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, কেউ কেউ আমার নামটা জেনে গেছেন, আর গুগ্ল করে বের করেছেন যে আমি লেখিকা, বই লিখেছি, সাংবাদিক, ইত্যাদি। তাদের তখন কী কৌতুহল! লেখিকা রান্না করছেন? এ আবার কী?
আমি বলি, কেন, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে না কি? লিখতে জানি বলে কি আর রাঁধতে জানব না? আর রান্নাটা যে মূলত শিল্পেরই একটা অংশ, সেটা যাঁরা শিল্প বোঝেন তাঁরা জানবেন। যাঁরা রান্না করতে ভালোবাসেন তাঁরা জানবেন যে রান্না করা একটা ছবি আঁকার মতন। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটিই লাগে রান্না করতে। দৃষ্টি - কেমন দেখতে হল খাবারটা, দেখে খেতে ইচ্ছে করছে কি? ঘ্রাণ - ঘ্রাণেই অর্ধ ভোজন! গন্ধতেই মাতাল করে দেবে, খিদে চারগুন বাড়িয়ে দেবে। শব্দ - ছ্যাঁক করে তেলে পড়ল কি না নুন-হলুদ মাখা মাছের গাদাটা, না হলে মাছ আটকে যাবে কড়ায়। রান্নার প্রতিটা স্তরের আওয়াজ ভিন্ন ভিন্ন। চচ্চড়ি ভাজা ভাজা হয়ে এলে ‘চিরচির’ শব্দতে বুঝিয়ে দেবে, এবার আঁচ নিভিয়ে দাও।
এবার স্পর্শ। বাজার করার সময় সব্জি-মাছ টাটকা কি না, তা স্পর্শ করেই বলা যায়। রান্না হয়ে গেলে, খাওয়ার সময় স্পর্শেই বলে দেওয়া যায় রান্নার স্বাদ কিরকম হতে পারে। যেমন ছোলার ডালটা একটু ভাঙ্গা-ভাঙ্গা, একদম মিক্সিতে বাটা নয়, পোস্তটা মিহি বাটা, যেমন মোচার চপের কামড়ে একটু বাদাম পড়ল মুখে। আহা! আমারই লিখতে লিখতে খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আমাকে কে খাওয়াবে? নিজেকেই রান্না করে খেতে হবে। আর জিভের কথা তো বাদই দিলাম। সে আসল বিচারক। তার প্রতি শতকোটি প্রণাম। শুধু জিভ? জিভের নানান প্রান্তর। স্বাদের নানান স্তর। এক গ্রাহক আমাকে বলেছিলেন, "তোমার বাঁধাকপিটার স্বাদের বিভিন্ন স্তর আছে।" কথাটা চিরকাল মনে থাকবে। এই বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি করতে লাগে ধৈর্য আর শিল্পকলা।
ভীষণ খিদে পেয়ে যাচ্ছে। খেয়ে আসি। না হলে লিখতে পারব না। সত্যি কথাই বলেছিলেন আমার আর এক গ্রাহক, "পেটে খেলে তবেই না পিঠে সইবে? পেটটা ভরালে তবেই ওঁরা আপনার লেখা পড়বেন।" তথাস্তু!
আরও পড়ুন: মাগুর মাছ, ইঁদুর, টিকটিকির ট্রেনিং দিতে দিতে কাহিল বাঙালি মা!
আরেকটা ইন্দ্রিয় আছে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সেটা যত্ন। ভালোবেসে, সযত্নে না রাঁধলে সে রান্নায় চমক থাকে না, শুধুই এলেবেলে রেস্তোরাঁর মতন স্বাদ হয়। সেই চমকটাই হ্যাং-লার ইউএসপি হিসেবে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। তবে এখন এই সার্বজনীন হেঁশেল চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। কারোর ঝাল বেশি লাগে তো কারোর কম। কারোর তেল বেশি লাগে, কারোর কম। "আমি মাছে একটু ঝোল বেশি ছাড়া ভাত খেতে পারি না," একজনের আবদার। মনে হয় বাঙালি মা’কে ছেড়ে সবে ক্যানাডায় এসেছেন চাকরি নিয়ে। "আমি কলাই ডাল খেতে পারি না, হড়হড়ে লাগে।" "আমি ইলিশ খাই না। কাঁটা মাছ খেতে পারি না।" ওরে, আমি তোদের মা নই রে!
"আমায় চারটে কাঁচালঙ্কা আর একটু লেবু পাঠিয়ে দেবেন? আর একটু গলা ভাত।" এই শেষের আবদারটা আমার সবচেয়ে পুরনো গ্রাহক, ৯০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এক সার্জনের। তিনি ক্যানাডার এক বিখ্যাত হাসপাতালের হেড ছিলেন। স্ত্রী মারা গেছেন বছর দশেক হল। তার পর থেকে বিশাল বাড়ি-গাড়ি বেচে দিয়ে নিজেই বৃদ্ধাশ্রমে চলে এসেছেন। বাঙালি রান্না করতে অসম্ভব ভালোবাসেন। কিন্তু এখানে রান্না করার উপায় নেই। কথায় কথায় দেশের কথা বলে ওঠেন, “আমাদের বাড়িতে যে বাটুনি ছিল...”।
আমার অনেক রান্নায় ফোড়ন উনি বলে দেন। আবার রান্নায় কী কম পড়েছে, ঠিক ধরতে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমে ক্যানাডিয়ান শুকনো পাস্তা, পিৎজা তাঁর মুখে রোচে না। ৫৫ বছর দেশের বাইরে, সমগ্র পৃথিবী ঘুরেছেন। এখন হ্যাং-লার খাবার গত আড়াই বছর ধরে খেয়ে তৃপ্তিতে আছেন। আমার সৌভাগ্য। আমার কর্তা আবার ওঁকে খাবার সাজিয়ে, বেড়ে দিয়ে আসেন। কেননা ওঁর মাঝে মাঝে "খেতে ইচ্ছে করে না"। বেড়ে দিলে চুপটি করে হাপুস-হুপুস করে খেয়ে নেন।
ক্যানাডায় যে বাঙালি এত আছেন, আমার জানা ছিল না। রোজ রোজ হ্যাং-লা পরিবারের সদস্য বাড়ছে। বাঙালি, সাথে গুজরাটি, যিনি বাঙালিকে বিয়ে করেছেন, আবার সাহেবও খাচ্ছেন কড়াইশুঁটির কচুরি, যাঁর সঙ্গিনী হয়তো বাঙালি। "পীজ টেস্ট্ সো গুড!" তাঁর চক্ষু ছানাবড়া!
আমার এক সাহেব বন্ধুকে পালং-শাকের চচ্চড়ি খাইয়েছিলাম, ঝালে বেচারার সাদা কান-মুখ বেগুনি হয়ে গেছিল! খেয়ে, ঘেমে-নেয়ে ন্যাপকিন দিয়ে অনেক কষ্টে সামলে বললেন, "আমাদের খাবার তো তোমাদের নিশ্চয়ই অখাদ্য লাগে?" আর একজন তো পাঁঠার মাংসের আলু চেয়ে চেয়ে খেয়েছিলেন, "আই নেভার হ্যাড পোটেটোজ সো টেস্টি!"
আরও পড়ুন: ক্যানাডায় ‘সাংস্কৃতিক বাঙালির’ স্টেজে এখন সাজ-সাজ রব!
এতদিন লজ্জা পেত বাঙালি নিজেদের ‘ভেতো’ বলতে। তুচ্ছ করত ভাত-ডাল। বিদেশি খাবার, এটা, সেটা, খুঁটে-খুঁটে খেয়ে জিভে চড়া পড়ে গিয়েছিল। এবার সে বুঝেছে শিখরে ওঠার জন্য দরকার শিকড়। বুদ্ধিমান বাঙালি তার শিকড়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে নতুন করে ‘ভেতো’ হতে। বাঙালি রান্না খেয়ে বুদ্ধিকে নতুন করে তেলে-ঝোলে-ডালে ডুবিয়ে শাণিয়ে নিতে।
সারা জীবন লেখালেখি করে পারলাম না সব মানুষের মন পেতে। হঠাৎ দেখি রান্না করে আমি সেখানে। মানুষের মন যে তার পেট বেয়েই, সেটা বুঝছি। এখন ক্যানাডায় আমি বেশ বিখ্যাত। আমাকে বাঙালি-মহল বেশ চেনে। না না, লেখিকা হিসেবে নয়। আমার চার-চারটে বই লেখা, দু-দেশে সাংবাদিকতা করা, নিজের ম্যাগাজিন বের করা, বা বইয়ের প্রকাশনী চালানো, কোনোটার জন্যই নয়। আমি বাঙালির পেট ছুঁয়েছি, থুড়ি, মন ছুঁয়ে গেছি হ্যাং-লার হেঁশেল ঠেলে। বিদেশে বাঙালিকে মাছে-ভাতে-শাকে-চচ্চড়িতে তার শিকড়ের সাথে ওতপ্রোত ভাবে বেঁধে রাখছি, বহাল তবিয়তে!