(সাইক্লিস্ট চন্দন বিশ্বাস এবার পায়ে হেঁটে নর্মদার তট ধরে যাত্রা পরিকল্পনা করেছেন। যাত্রাপথ থেকেই লিখে পাঠাচ্ছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য)
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম নর্মদার মোহনার উদ্দেশে। জায়গাটির নাম দহেজ। বরোদা থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার। গাড়িতে সময় লাগবে প্রায় আড়াই-তিন ঘন্টা। সুন্দর একটা সকাল। রাস্তায় মাঝামাঝি পড়ল ভারুচ। সেইখান থেকে সঙ্গ দিল অভিজিৎদা, অভিজিৎ পাল। সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছে গেলুম দহেজ এলাকায়। মূল মোহনা তখনও প্রায় ১০ কিলোমিটার। এটি পুরোপুরি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট। বড় বড় প্রায় সব কোম্পানির কারখানা রয়েছে এখানে। বাতাস ভারী হয়ে আছে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসের গন্ধে। খুব আশ্চর্য লাগল এবং কষ্ট হল যারা কাজ করেন এই কারখানাগুলিতে তাদের জন্য। বেশিদিন এই অঞ্চলে যাতায়াত বা বসবাস করলে শরীর খারাপ হতে বাধ্য। আমার কিছুই করার নেই। আরও এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার দিকে।
ন’টা নাগাদ পৌঁছে গেলুম মোহনার কাছাকাছি। কিন্তু সেখানে পৌঁছে আরেক বিপত্তি। পরিষ্কার মোহনা বলতে কিছুই নেই। সব জায়গায় কারখানা। সরকার মোটামুটিভাবে মোহনাটাকে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানিগুলিকে কারখানা তৈরি করার জন্য। আর গাইড করার জন্য কেউ নেই যে আসল মোহনার দিকে দিকনির্দেশনা দেবে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল একটা জেটি, যেটাকে মোহনা হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আমার অভিযান শুরু করব এইখান থেকেই। ভারত এবং আমার সংগঠন সোনারপুর আরোহীর পতাকা নিয়ে ছবিতোলা পর্ব চলল। কিন্তু শুরু যে করব নদীর পাশ দিয়ে রাস্তা কই? নদী দখল করে নিয়ে সব কারখানা। মাথায় হাত। গাড়িতে করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। ১০, ২০, ৩০ কিলোমিটার চলে এলাম, কিন্তু ঠিকঠাক হাঁটার রাস্তাই পেলাম না। ততক্ষণে বেজে গেছে দুপুর সাড়ে বারোটা। আর যদি রাস্তাও পাই তো এগোনো উচিৎ হবে না। সেদিনের মত অভিযান বাতিল করলাম। আজকের আস্তানা ভারুচ। অভিজিৎদার বাড়ি। মন খুবই খারাপ। অভিযানের প্রথমদিনই যদি বাধা আসে তো মন খারাপ হওয়ারই কথা। অভিজিৎদা মন ভালো করার জন্য কিনে নিয়ে এল বিরাট বড় এক ইলিশ মাছ। যাইহোক অভিজিৎদা, সৌমীদি এবং ওদের দুই ছোট ছেলের সান্নিধ্যে ঘরোয়া পরিবেশে শান্ত হল মন। ঠিক করলাম পরের দিন নদীর পাড় পাই আর না পাই হাঁটতে শুরু করব। তট পেলে ভালো, না পেলে মেটাল রোড দিয়েই হাঁটব। অভিযান শুরু করতেই হবে।
সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়লাম ভারুচ থেকে। প্রথমেই চলে গেলাম নর্মদার তীরে। ভারুচে রয়েছে বহু পুরোনো গোল্ডেন ব্রিজ। ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এই ব্রিজে একটি জিনিস লক্ষ্যণীয় যে এখনকার মত কে উদ্বোধন করেছেন সেই নাম লেখা নেই। লেখা রয়েছে যে ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে তৈরী হয়েছে তার নাম। তখন মানুষ শিক্ষিত ছিল। এখন তো কে খুঁটি পুটেছেন, কে শিল্যান্যাস করেছেন, কে উদ্বোধন করেছেন, কে প্রথম চলাচল করেছেন সবার নাম লেখা থাকে। শুধু লেখা থাকে না কারা তৈরি করেছেন। হেঁটে দেড় কিলোমিটারের ব্রিজ পেরিয়ে চলে গেলুম নর্মদার দক্ষিণতটে। শুরু হয়ে গেল আমার নর্মদা অভিযান। অনাবিল আনন্দ।
প্রায় নাচতে নাচতেই হাঁটছি। নর্মদার পাড় দিয়ে হাঁটতে পারছি না তো কি হয়েছে, হাঁটছি তো। আসলে মোহনার কাছাকাছি বলেই নদী এখানে ভঙ্গুর। বারবার গতিপথও পরিবর্তন হতে পারে। তাই পাড় দিয়ে হাঁটার কোনো উপায় নেই, রাস্তাও নেই। ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর নামল বৃষ্টি। তাতে হাঁটা কিন্তু বন্ধ হল না। বৃষ্টির মধ্যেই এগোচ্ছি। বর্ষাকালে অভিযানে বেরিয়েছি, বৃষ্টি হবে সেটা ধরে নিয়েই। এবং এগোচ্ছি গুজরাটের গ্রামের মধ্যে দিয়ে। সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। ভাষা কিছুই বুঝতে পারছি না। তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। আকার ইঙ্গিতের ভাষা পৃথিবীর সব জায়গাতেই এক। কখনও বড় রাস্তা কখনও গ্রাম। কোথাও আবার জলাভূমি। ভুলেই গেলাম দুপুরের খাবারের কথা। সেদিনের গন্তব্য ঠিক করেছিলাম মাধী নামের এক জায়গা। সেখানে রামঘাটের কাছে একটি শিবের মন্দির রয়েছে। বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম কাছাকাছি। আর মাত্র চার কিলোমিটার বাকি। হাঁটছি। হঠাৎ করে গ্রামের এক ভদ্রলোক মোটরবাইক নিয়ে এগিয়ে এলেন। বাকিটা আমায় পৌঁছে দেবেন। হিন্দিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে হেঁটেই যাব। কিন্তু তিনি বুঝবেন না। পণ করেছেন পৌঁছে দেবেন তো পৌঁছে দেবেনই। বেশ তাই হোক! পৌঁছে গেলাম সেইদিনের গন্তব্যে। মোট হেঁটেছি ২৯ কিলোমিটার। ভাবা হয়েছিল অভিযান শুরু করব হালকা হাঁটা দিয়ে। প্রথমদিন ১০-১২ কিলোমিটার, দ্বিতীয়দিন ১৭-১৮ কিলোমিটার, তারপরদিন আরেকটু বেশি। কিন্তু হাঁটার আনন্দে প্রথমদিনেই ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়েছি।
আরও পড়ুন, পায়ে হেঁটে, ইচ্ছে মত নর্মদা (দ্বিতীয় চরণ)
প্রথমদিন অর্থাৎ ১৪ই জুলাই হাঁটা তো সফলভাবে শেষ হল কিন্তু তারপরে অপেক্ষা করছিল আরেকটি আনন্দসংবাদ। আমার ছাত্রাবস্থার তিন বন্ধু অনিরুদ্ধ চ্যাং, সৌরভ ঠক্কর এবং সন্দীপন মজুমদার সুদূর মুম্বাই থেকে মোটরবাইক নিয়ে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসছে আমার সঙ্গে দেখা করতে এবং আমায় উৎসাহ দিতে। আমি তো অবাক। আমি হাঁটা শেষ করার পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই ওদের আগমন হল। টাইমিং ভালোই মিলেছে। অল্প কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পরেই আমায় মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে যাওয়া হল রাতের আস্তানার সন্ধানে। ওখানে কোনো হোটেল নেই। আবার যেতে হল ভারুচ। শুরু হল আড্ডা। ওদের সঙ্গে প্রায় আট বছর পরে দেখা। আড্ডা আর শেষ হয় না। রাত বারোটা বেজে গেল। ওখানে বসেই ঠিক হল পরেরবার ওরা মোটরবাইক নিয়ে মুম্বাই থেকে কলকাতা আসবে। আমার বাড়ি থাকবে।
পরদিন ওরা আমাকে যেখান থেকে তুলেছিল সেইখানে নামিয়ে দিয়ে রওনা দিল মুম্বাই। আর আমি চললাম নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করতে। এটা আমার বহু পুরোনো অভ্যেস। যেহেতু একা বেরোই তাই এই ব্যবস্থা। যদি কোনো বিপদে পড়ি তো পুলিশ উদ্ধার করলেও করতে পারে। কাছাকাছি থানা বলতে রাজপারডি। রিপোর্ট করে খানিক গল্পগুজব করলাম ওদের সঙ্গে। আজ যাব বাদাবন পর্যন্ত।
নর্মদার তীর ধরে হাঁটছি শুনে আলতাফ হুসেন নামের এক ব্যক্তি ধরে চা খাইয়ে দিলেন। উপস্থিত হলাম নর্মদা তীরে বহু পুরোনো ‘মণিনাগেশ্বর মহাদেব মন্দিরে’।
এখানে থাকেন জনাসাতেক সন্ত, আটটা গরু, চারটি ময়ূর, অজস্র সাপ এবং কিছু কুমির। সবাই খুবই ভালো। প্রধান মহারাজ পাম্প ঠিক করতে ব্যস্ত। আমিও মহারাজের সঙ্গে জলের পাম্প ঠিক করতে লেগে গেলাম। আমার নতুন প্রতিভার বিকাশ ঘটল। পরদিন সকালে বৃষ্টির কারণে বেরোতে পারলাম না। প্রধান মহারাজ ব্রহ্মচারী বিরাগচৈতন্যবাবুর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। ম্যাঙ্গালোরের এই ভদ্রলোক অত্যন্ত শিক্ষিত, ওঁর মত পলিটিকালি নিউট্রাল কিন্তু সাউন্ড কোনো সাধু আজ অবধি দেখিনি। নর্মদা ড্যাম, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থান থেকে ইজরায়েল আর্মি সব বিষয়েই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হল। মহাত্মাদের মোবাইল রিচার্জ করে দেওয়ার কাজটাও পেলাম। দুজনের করে দিয়েছি। এটাই মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ নেশা এবং পেশা।