Advertisment

Delhi Durga Puja 2018: দিল্লিওয়ালা দুর্গাপুজো- নবমী ও দশমী

রাম হাত জোড় করে দাঁড়াতেই, দেবী দুর্গা তিরস্কার করলেন, ‘এই জন্য তোমাকে লোকে হাঁদা গঙ্গারাম বলে। বলি অগ্যস্ত মুনি যে ব্রহ্মার তীরটা অত কষ্ট করে এনে দিল সেটা কী ব্যাঙ্কের লকারে তুলে রাখার জন্য নাকি শোপিস? ওটা ইস্তেমাল আর করবে কবে হে? রাবণকে বলে দিয়েছি! ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সেই আবার একবার কথিতের আশ্রয়ে ফিরে যাই। কথিত আছে যে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন (দেবদেবীরা বোধহয় হত্যা, খুন ইত্যাদি করেন না!)। তাই অষ্টমীর ২৪ মিনিট এবং নবমীর প্রথম ২৪ মিনিট নিয়ে সন্ধিপুজো করা হয়।

Advertisment

নবমীর পুজো দেবী বন্দনার পুজো। দেবীর বিজয়ে ভূলোক-দ্যুলোক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং দেবী বন্দনায় রত হয়। শেষে বিজয়া দশমী আসে যেদিন দেব ও মানব দেবীর বিজয় উৎসবে মাতোয়ারা হয়।

কিন্তু এটা তো রামচন্দ্রের স্টেজ ছিল! দুর্গাপুজো তো করেছিলেন নাকি সুরথ রাজা। বসন্তকালে। হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে মেধা ঋষির পরামর্শে। আর রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারে গিয়েছিলেন শরৎকালেই। কিন্তু কিছুতেই রাবণকে কব্জা করতে পারছিলেন না। তাই ১০৮টি পদ্ম সহযোগে ন’দিন ব্যাপী দুর্গার অকাল বোধন করেন। শেষে নবমীর দেবী দুর্গার সিদ্ধিদাত্রীর রূপকে বন্দনা করে রাবণের মৃত্যু কামনায় পুজো করতে হবে। কিন্তু সেই রকম পুরোহিত কই? শেষে মহা ব্রাহ্মণ রাবণকেই আমন্ত্রণ জানানো হল তাঁর নিজের মৃত্যু কামনার পুজো করার জন্য। রাবণ বুড়ো বয়সে একটু পরস্ত্রীর সৌন্দর্য্যে কাবু হয়ে গেছিলেন বটে। কিন্তু এসব দিকে খুব সোজা সাপটা ছিলেন। দেব দেবী পুজো অর্চনা এসব ব্যাপারে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। তাই কি আর করা যাবে। দেবী দুর্গার কাছে নিজেই বললেন যে, ‘আমি বড়ই দুষ্টু টুষ্টু হয়ে গেছি। উলটো পালটা কাজ ফাজ করেছি। আর আগের মতো সেই বালী রাজাও নেই যে আমায় ল্যাজে নিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসবে। আর কার্তবীর্যার্জুনও নেই যে বগলে চেপে জ্ঞান চক্ষু খুলে দেবে। তাই এই বাচ্চা রাম হি সহি। দাও এর হাতে আমার মরণ বাণ তুলে।’

আর দেবী দুর্গা এরকম অনার্য উপজাতি রাজা ফাজার মৃত্যু (না না সরি সরি বধ হবে, বধ), মানে এসব ব্যাপারে খুবই পজিটিভ বরাবর। তাই কালক্ষেপ না করে রাবণকে বললেন, ‘আগামীকল্য এতদবসরে তোমাকে মরতে হবে। এখন যাও রামকে ডেকে দাও!’ রাম হাত জোড় করে দাঁড়াতেই, দেবী দুর্গা তিরস্কার করলেন, ‘এই জন্য তোমাকে লোকে হাঁদা গঙ্গারাম বলে। বলি অগ্যস্ত মুনি যে ব্রহ্মার তীরটা অত কষ্ট করে এনে দিল সেটা কী ব্যাঙ্কের লকারে তুলে রাখার জন্য নাকি শোপিস? ওটা ইস্তেমাল আর করবে কবে হে? রাবণকে বলে দিয়েছি! ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। কাল গিয়ে পটাং করে মারবে ওর হৃদয় লক্ষ্য করে। আর রাবণ মহিষাসুর এরা সব হৃদয় ফৃদয়ের ব্যাপারে দুর্বল। তাই বধ হতেও (হ্যাঁ এবার ঠিকা আছে) দেরী করবে না।

যেমন ভাবা তেমন কাজ।তবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে রাম যুদ্ধের আমেজে গিয়েছিলেন ভুলে। রামের সারথি মাতলি মনে করালেন ভাগ্যিস, তাই আজ বিজয়া দশমী।

আরও পড়ুন, Delhi Durga Puja 2018: দিল্লিওয়ালা দুর্গাপুজো- অষ্টমী

আবার এই বিশেষ দিনে একা অর্জুন যুদ্ধবলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, কৃপাচার্য, কৃপ, শকুনি সহ দশ অক্ষৌহিণী সৈন্যকে পরাস্ত করেন ধর্মের বিজয় স্থাপনের পথ রচনা করেন।

তা সেসব থাক। উত্তর ভারতে যতটা না বিজয়া দশমী বা দুর্গাপুজো, তার থেকেও বেশি দশেরা উৎসব। সে অবশ্য দক্ষিণের মহীশুরেও একই গল্প। স্থানীয় মহিষাসুর রাজার কুশাসনের অন্তের জন্য দেবী দুর্গার আনয়ন ও বিজয়।

হিমাচলের কুলু উপত্যকায় আশেপাশের দশটি গ্রাম থেকে শোভাযাত্রা আসে রাবণ পোড়ানোর জন্য। তারপর তীর ক্ষেপণ ও অগ্নি সংযোগ। রাবণের সঙ্গে সঙ্গে কুম্ভকর্ণ ও ইন্দ্রজিতও ভস্ম হয়ে যান। বছর দুয়েক আগে ঋষিকেশের ত্রিবেণী সঙ্গমে দশেরা উৎসব দেখা আমার। অবর্ননীয় সে দৃশ্য। তবে তার আগে রামলীলার রাবণকে ঘোড়ার গাড়িতে বসে ঘুমোতে দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে গিয়েছিল।

দিল্লিতে রামলীলা ময়দান আর আমার বাড়ির খুব কাছে ইন্দ্রপ্রস্থ রামলীলা কমিটি এবং কামধেনু রামলীলা কমিটির দশেরা হয়। রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং ইন্দ্রজিতের পুতুল তৈরী হয় উত্তর দিল্লির রাজৌরি গার্ডেন এলাকায়। রাস্তার দুধার জুড়ে প্রায় সারা বছর ধরে এর প্রস্তুতি হয়। বাঁশের চ্যাঙারী দিয়ে জালার মতো করে কাঠামো তৈরি হয়। তারপর পকেট তৈরি হয় বিশেষ বিশেষ শব্দবাজী ভরার জন্য শেষে খবরের কাগজ রঙ করে চড়ানো। এক একটা মুখ এক একটা মানুষের থেকেও বড়। সে যাই হোক। লালকেল্লার রামলীলা ময়দান আজ লোকে লোকারণ্য থাকবে, তিল ধারণের স্থান থাকবে না।

publive-image

তবে বলার কথা ছিল গুরুগ্রাম বা গুড়গাঁওএর দুর্গাপুজো নিয়ে। গুরুগ্রামের ১৪টি পুজো কমিটি একসঙ্গে একটা মস্ত কাজ করে ফেলেছে। অবশ্য ২০১৬ থেকেই চলছে কাজটা। গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৬য় একটি অস্থায়ী পুকুর তৈরি করে সেখানে কাঠামো সমেত বিসর্জন দিয়ে কাঠামো তুলে নিয়ে রাতের মধ্যেই পুকুর বুজিয়ে সমান্তরাল করে দেওয়া হবে। পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা শিক্ষণীয় তো বটেই।

গুরুগ্রামের দু তিনটি পুজোতে আসুন ঘুরে আসি। প্রথমেডিসিডিপি কালচারাল সোসাইটি। এই পুজোটি শুরু হয়েছে ১৯৯২ থেকে।বিশেষ আকর্ষণ বিশেষভাবে অন্নকূট সন্ধিপূজা ধুনুচিনাচ। প্রতি বছর প্রতিমা ও পূজামণ্ডপ তৈরি হয় পরিবেশ বান্ধব উপকরণ ব্যবহার করে। বঙ্গীয় পরিষদ গুরুগ্রামের পুজো ২০০৬ সালে শুরু। প্রতি বছর থিম পুজো করা হয়। এবারে থিম শঙ্খ। অষ্টমীর সকালে প্রায় ৫০০ জন এক যোগে শঙ্খ বাজিয়ে রেকর্ড করেছেন এখানে। ডিএলএফ ৫এর দুর্গাপুজো এবারে ৫ বছরে পা দিল। এটিও পরিবেশ সচেতন পুজো।

কাল নবমীর পরিক্রমা শুরু এবং শেষ হয়েছিল কিন্তু দুটি বিশেষ পুজো দিয়ে। আমার বাড়ির কাছের পুজো। একটি হল ইন্দ্রপ্রস্থ মাতৃমন্দির নির্মাণ সোসাইটির পূজা সমিতির পুজো। বাড়ির কাছে হবার জন্য আমরা সদস্যও হয়েছি। কিন্তু গেলাম কাল প্রথমবার। আর গিয়েই চমৎকৃত। প্রায় দশজন শিল্পী পরিশ্রম করে প্রতিমার মুল কাঠামোর উপরের পরত এবং পোশাক ও অস্ত্র খবরের কাগজ দিয়ে করা।

আরও পড়ুন, Delhi Durga Puja 2018: দিল্লিওয়ালা দুর্গাপুজো- সপ্তমী

উনত্রিশে পদার্পণ করা এই পুজো মণ্ডপে যখন পৌঁছলাম তখন এক বিশেষ ক্যুইজ শো চলছে সেখানে। সাধারণ কিন্তু উইটি! বলুন দেখি, কোন কমন উপকরণ হকি, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন বা ভলিবলে ব্যবহৃত হয়। ক্রিকেটেও হয়। তবে মূল খেলার বাইরে। অথবা রেবতী, অনুষ্কা শেট্টি, উর্মিলা কানিতকার, টাবু, আলিয়া ভাট এবং কঙ্কনা সেনশর্মার মধ্যে ব্যতিক্রম কে?

প্রথমটির উত্তর নেট। ক্রিকেটে শুধুমাত্র প্র্যাকটিসে ব্যবহৃত হয়। আর দ্বিতীয়টির উত্তর কেউ নয়। সকলেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির। এইরকম আর কি। জামাই ঠকানো প্রশ্ন কিন্তু তার মধ্যে কোথাও না কোথাও সাধারণ জ্ঞানের খবর লুকিয়ে আছে।

সমগ্র পরিবেশেই কেমন একটা আপন আপন ভাব। অথচ প্রফেশনালিজম বিবর্জিত নয়।

আর কালকের ভ্রমণ শেষ করা হল পূর্বাঞ্চলের দুর্গাপুজো দিয়ে। সেই যে সেই পুজো, যেখানে গতবছর পুলিশ কিংবা সংশ্লিষ্ট অধিকারীদের পক্ষ থেকে তখনই পুজো করবার অনুমতি মিলেছিল যখন পুজো কমিটি মেনে নিয়েছিল যে ধর্মীয় ভাবাবেগে (?) আঘাত দিয়ে পূজা মণ্ডপে আমিষ ভক্ষণ চলবে না।

এবারে কিন্তু দেখলাম আমিষ খাদ্যের স্টল লেগেছে। ভালো লাগল। কোন ভাবে যেন আগ্রাসনটিকে থামানো গেছে।

আজ সন্ধ্যে হলেই ভাসান। দিল্লিতে প্রায় সাড়ে চারশো পুজো কমিটি একত্রে যমুনার এক নাতিগভীর অঞ্চলে ভাসান দেয় লাইন দিয়ে। সুন্দর ব্যবস্থা। ক্রেনের মাধ্যমে কাঠামো তুলে নেওয়া হয় সঙ্গে চাঁদমালা এবং অন্যান্য অদ্রাব্য সামগ্রী। বাকীরা অস্থায়ী পুকুর খুঁড়ে বিসর্জন দিয়ে পরিবেশে নিজের অঙ্গীকারটুকু রাখবেন। অথবা স্থানীয়ভাবেই বিসর্জন দেবেন। আর তারপরেই বিজয়ার প্রণাম, শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ।

গত কয়েকদিন ধরে আপনাদের সঙ্গে থেকে দিল্লিওয়ালা দুর্গাপুজোর একটা ‘আঁখো দেখি হাল’ দেবার চেষ্টা করলাম। ফরিদাবাদ অথবা পশ্চিম বিহার অথবা উত্তর দিল্লি যাওয়া হল না সময়াভাবে। গতবছর যেমন পশ্চিম বিহার বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশনের বা নিবেদিতা এনক্লেভের পুজো খুব আন্তরিক লেগেছিল। যেমন লেগেছিল ফরিদাবাদ সেক্টর ৪৭এর পুজো। যা মূল দিল্লি থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিমি দূরে। উত্তরী আগ্রাসন তো অবশ্যই আছে। থাকবেও। কিন্তু তারই মধ্যে বাঙালিয়ানার ধ্বজা দৃপ্ত ভঙ্গীতে পতপত করে হাওয়ার দিকে উড়ছে দেখে ভালোই লাগে। তবু পুজো কমিটিগুলো যেন শুধুমাত্র শারদ তৎপরতায় মেতে না গিয়ে সারা বছর বঙ্গ সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে সেই আশা রাখি।

আর একটা কথা। কলকাতার পুজোগুলোতে এখন থিম আর স্টাইলের ছড়াছড়ি। প্রাণটা প্রায় চাপাই পড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে পুজো উপলক্ষ্যে পুরস্কারগুলো। দিল্লিতে আগে টাইমস অব ইন্ডিয়া করত। বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনও পরিবেশ বান্ধব পুজো প্রতিযোগিতা করে ‘শক্তিভূতে সনাতনী’, যা দিল্লির পুজো কমিটিগুলির মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। কিন্তু ইদানীং বেশ কয়েকটি পুজোর মধ্যে অন্তরহীন স্টাইলাইজেশন দেখা যাচ্ছে। তাতে প্রাণ থাকে না যে! এই কথাটা ভুলে গেলে কিন্তু লাভের গুড় অন্য কেউ খেয়ে চলে যাবে। আর বঙ্গ সংস্কৃতি, যা দিল্লির বুকে প্রায় দুই শতাব্দী মাথা উঁচু করে লড়ে টিকে আছে তার পাঁজরে কঠিন আঘাত লাগবে। দুর্গাপুজো বাঙালির প্রাণ, মনের উৎসব। প্রাণ ও মন ছাড়া বৈভবের উৎসব হয়ে যেন তার পরিচিতি না হয় সেটা দেখাও পুজো কমিটিগুলোর কর্তব্য।

ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং উৎসবের দিনগুলিও যাঁদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি, তাদের পাশে থাকুন। তাহলেই বোধহয় দেবী দুর্গার ত্রিশূলাঘাতে অনৈতিক অসুর পরাস্ত হবে এবং সত্য ও মনুষ্যত্বের বিজয় গাথা রচিত হবে বারংবার।

শুভ বিজয়া।

Durga Puja 2019
Advertisment