সালটা ১৯৮৮। কিশোর কুমারের মৃত্যুর পরে ওঁর গাওয়া একটা গান রিলিজ করেছিল। ছবিটার নাম জ্যোতি। সঙ্গীত নির্দেশক ছিলেন পুণ্যব্রত সেন এবং জগন্ময় মিত্র, জনপ্রিয় ভাবে যাঁদের জুটির নাম ছিল স্বপন-জগমোহন। প্রসেনজিত, রামেশ্বরী এবং অনুরাধা প্যাটেল। গানটির রচয়িতা যিনি, সেই মুকুল দত্ত বোধহয় ছিলেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ভেবে দেখুন পাঠক/ পাঠিকা, আজ থেকে তিরিশ বছর আগেই এক গীতিকার আজকের দিল্লি বা আশেপাশের অঞ্চলের দূষণের গান লিখে চলে গেছেনঃ
“পারি না সইতে
না পারি কইতে
তুমি কি কুয়াশা
ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া...”
আরও পড়ুন, দিল্লি লাইভলি: পক্ষ-অন্তর (৪)
ভাবা যায়? মানে এখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। সূর্যের আর সেই তেজ নেই। পাখিরা ডাকাডাকি করছে না। কুকুরেরা ঘেউঘেউ করছে না। গাছপালা নিস্তেজ। সর্বত্র যেন এক ধোঁয়াশার চাদর। গতবছর খুব ঘটা করে লিখলাম এক জায়গায়-
“দিল্লিতে থাকি, গত বছর থেকে ঠিক দীপাবলির পরে আপাত হেমন্তের আগমনকে ধোঁয়া দিয়ে ঢেকে দিয়ে শীতকে ওয়েলকাম করার জন্য দূষণের কম্বল আমদানি হচ্ছে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র আর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা নাকে চশমা এঁটে গলার টাই বা শাড়ির প্লিট ঠিক করে গম্ভীরভাবে পিএম ২.৫ আর পিএম ১০ (বায়ুদূষণের পরিমাপক পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ এবং ১০ মাইক্রোমিটার) নিয়ে গম্ভীরভাবে বুঝিয়ে যাচ্ছেন যে বিপদসীমার কতটা উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার কারণ নিয়ে তো প্রচুর বার্তালাপ। কিন্তু কী করলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারবেন সেটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। যা করলে সমস্যা, তা দূর কর আর যা করলে সমস্যার সমাধান হবে সেগুলো ফটাফট করতে শুরু কর।”
কিন্তু তাই নিয়েই লোকজন তর্ক জুড়ল। কালী পুজো ট্র্যাডিশন, দিওয়ালি সেরা উৎসব, চাষারা ফসল তুলে ফেলার পর খড় নিয়ে কী করবে, সব নির্মাণকার্য বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, ট্রাকগুলো আটকানো সম্ভব নয়।
দিল্লি সরকারকে বললে তারা বক দেখানোর মতো অড ইভন চালু করে দেবে। জোড় তারিখে জোড় নম্বরের গাড়ি আর বিজোড় তারিখে বিজোড় নম্বরের গাড়ি। এই আর কি। অথচ কদিন আগেই কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রণালয় যখন দিল্লি রীজের গাছ কেটে কর্মচারীদের জন্য বাড়ি বানাতে ছুটেছিল তখন সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে তোয়াক্কা করা হয়নি। শেষে বিচারব্যবস্থার সুবুদ্ধি সে যাত্রা বাঁচিয়ে দেয়।
লিপ সার্ভিস পেরিয়ে রাজপথগুলিতে ধারে ধারে স্পাইডার প্ল্যান্ট লাগানো অবশ্য হচ্ছে। স্পাইডার প্ল্যান্ট দূষণ শুষে নেয়। কিন্তু এটুকুই। কাল যদি সোনা রুপোর থেকে জল আর অক্সিজেন মাস্ক বেশি দামি হয়ে পড়ে তাহলে দায় কে নেবে? দূরদৃষ্টিহীন রাজনেতারা নাকি বর্তমানে মজে থাকা সাধারণ মানুষ?
তাহলে কি এই ধোঁয়ার বিষ থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই? আছে আছে অবশ্যই আছে। এই তো নিচেই লেখা আছে-
শুকনো ধুলো যাতে না হয় তাই দিবারাত্র সুবহশাম সুপার সুইপার মেশিন দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার।
বাতাসের ধূলিকণাগুলিকে ভিজিয়ে দিয়ে মাটিতে ফেলার জন্য যান্ত্রিক ফোয়ারা ব্যবহার।
বায়ু সংশোধক বা এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার।
অডইভনের মতো একটা জগাখিচুড়ি দেখনদারী সিস্টেমকে জনগণের ঘাড়ে না চাপিয়ে জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে সক্ষম এবং সুসফরের উপযুক্ত করে তোলা। যাতে ব্যক্তিগত বাহন ব্যবহার কম করলেও অসুবিধা না হয়।
আশেপাশের ক্ষেতখামারের কৃষকবন্ধুদের শিক্ষিত করে তোলা, যাতে খরিফ ফসল কেটে তোলার পর রবি শস্য বোনার আগের সময়টিতে খড় এবং শস্য গাছের অব্যবহৃত শুকিয়ে যাওয়া অংশটিকে দ্রুত সরিয়ে ফেলার জন্য জ্বালিয়ে না দিয়ে তা যেন সার বা গবাদি পশুর খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়।
আর কেউ নিয়ম না মানলে? তাহলে ভোটের রাজনীতিই করুক। মানব সভ্যতা যাক কেরোসিনের লাইনে।
গাড়িটাড়ি থেকে বায়ুদূষণ দূর করার জন্য যেটা করা যেতে পারত তা হল, ডিজেলের ব্যক্তিগত বাহন বিক্রি বন্ধ করা এবং মালবাহী ট্রাকগুলিকে শহরের বাইরে বাইপাস দিয়ে চলাচল করানোর জন্য করিডোর সৃষ্টি।
আর ইয়ে আরএকটা অপ্রিয় কথা বলব নাকি? ওই শব্দ বা আলোকবাজি উভয়কেই গুলি মারুন। ট্র্যাডিশন দিয়ে বুঝলেন, সব সময় বেঁচে থাকা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করতে হয়, আধুনিকতার আরেক নাম বাস্তবচিন্তাও বটে।
তাই ওই দীপাবলিকে শব্দ বা বাজির উৎসব থেকে ঝটপট আলোর উৎসবে পালটে ফেলুন দেখি। আফটার অল ভবিষ্যতের প্রতি আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি? সব কিছু সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের উপর ফেলে রাখলে হবে? শিশুর বাসযোগ্য বিশ্বের দায় কিন্তু আমার আপনার, সবারই!