Advertisment

দিল্লি লাইভলি: পক্ষ-অন্তর (৪)

সংসারের জোয়াল আর ঘোমটার ওজনে ঘাড় নুইয়ে পড়ার অবস্থা। কিন্তু সকালটা ঠিক রেজোলিউটলি পার্কে এসে মর্ণিং ওয়াক করছেন অথবা জিমে ঘাড় গুঁজে নিজের ব্যায়াম করে চলেছেন। এই ডেডিকেশন বিরল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- জয়ন্ত মিস্ত্রি

মর্ণিং শোস দ্য ডে

Advertisment

এই যে গত এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার শারীরিক কসরৎ নিয়ে লিখতে যাচ্ছি এর মানে এই নয় যে বেহদ পেটানো চেহারা নিয়ে আমি মধ্য চল্লিশে হৃত্বিক রোশন হয়ে ঘোরাফেরা করছি। আসলে আমি বরাবরই মনে করি যে কুড়ি থেকে পঁয়তাল্লিশ যে মেহনত মানুষ করবে তা বাকি জীবন বসে বসে খাবে। আর আমার তো হাজারটা গেরো। ডান হাঁটু, দুই কাঁধ মাঝে মাঝে কোমরের পাশে ক্র্যাম্প এ সব তো রয়েইছে।

সে যাই হোক, দিল্লির মুখ্যমন্ত্র হিসাবে কেজরিবাবুকে যতই গাল্গাল করি না কেন। ভদ্রলোক শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন সঠিক ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন বটে। সেটা নিয়ে পরে কখনও বলব। তবে আরেকটা কাজ তিনি করেছেন। দিল্লির পার্কে পার্কে কিছু ফ্রি হ্যান্ড জিম ইক্যুইপমেন্ট লাগিয়ে দিয়েছেন। বা লাগাতে শুরু করেছিলেন, আর তাঁর দেখাদেখি ভিন্ন ভিন্ন পার্টির আরও বিধায়ক ও সাংসদও লাগাচ্ছেন। এগুলো খুব সফিস্টিকেটেড ইক্যুইপমেন্ট নয়। নিজের শারীরিক ওজনকে হাতিয়ার করে আপনার হাত পা বা কাঁধের ব্যায়াম করা যায়।

কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। জীবনে যে সব ব্যক্তি মাল্টিজিম নামক বস্তুতে বিশ্বাস করেননি, তাঁরাই এই পুজোর পুরোহিত হয়ে বসছেন। গত দু মাস হল মেয়ের স্কুলের স্বার্থে আমাদের নিজের গাজিয়াবাদ স্থিত বাড়িটি ছেড়ে আমরা উঠে এসেছি পূর্ব দিল্লির আইপি এক্সটেনশনের একটি সোসাইটিতে। তার পিছনের যে পার্ক্টি আছে সেখানে প্রবেশের জন্য বিশেষ বায়োমেট্রিক কার্ডও আছে। হেঁটে গিয়ে টুক করে ঢুকে পড় টাইপের। ফলে ফিটনেসের প্রতি যে সুপ্ত ইচ্ছা সেটা গত দুইমাসে জল হাওয়া পাচ্ছে বটে।

আরও পড়ুন, দিল্লি লাইভলি: পক্ষ-অন্তর (৩)

এমনিতে পার্কের জিমের অংশটি সকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু সেসবই ট্রেনের লেডিজ কামরা আর বাসের লেডিজ সীট হয়ে দাঁড়ায়। একবারই গিয়েছিলাম ভোরবেলা উঠে, ঘুম আসছিল না। তো ভাবলাম, যাই গিয়ে পার্কটা খান পাঁচেক চক্কর মেরে ওয়াকারে নিজের নির্দিষ্ট ব্যায়ামটা করে রাখি। আসলে গত বছর থেকে প্রায় এক দশক পরে অফিস লীগ খেলছি। মন্দ পারফর্ম না করার পরেও যে সমস্যাটা হচ্ছিল সেটি হল ক্র্যাম্প। আগেই উল্লেখ করলাম যে আমার ডান হাঁটুর সমস্যা আছে। আংশিক লিগামেন্ট টিয়ার। যা নিয়ে মাঝেসাঝেই ক্যাচ কট কট সিচুয়েশন হয়ে যায়। তা ক্রিকেট খেলার সময় হাঁটুতে ক্রেপ বেঁধে, তার উপর নী ক্যাপ বেঁধে নামছি। ব্যাটিং করতে গিয়ে আবার প্যাডও বাঁধতে হচ্ছে। ফলে চকিতে দ্রুত সিঙ্গলস নিতে গেলেই হ্যামস্ট্রিঙের দফারফা হচ্ছে। আর বাকি ইনিংসটা লেংচে লেংচে ব্যাট করে গেছি।

তাই এবছর ঠিক করে রেখেছিলাম যে আর যাই হোক সঠিক স্ট্রেচিং এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে হ্যামস্ট্রিংকে ঠিক যায়গায় রাখতে হবে। তাই পার্ক, তাই পার্ক জিম।

আমাদের সোসাইটির পিছনের পার্কটি বেশ মজার। তাতে সকাল সন্ধ্যে গান বাজে। সন্ধ্যা গজল সম্রাট জগজিৎ সিং বা হালকা সন্তুর। কিন্তু সকালবেলায় ভক্তিগীতির চক্করে প্রাণ ওষ্ঠাগত। একদিন শুনলাম ভোর সাতটায় বাজছে, সোনু নিগমের কণ্ঠে, ‘তেরি দুনিয়া সে জি ভর গয়া, মুঝে আব বুলালে মাতা শেরাওয়ালি’ টাইপের কোন গান।

আরও আছে। বনগাঁ লোকালে লোকজনকে দেখেছি ইয়ারফোন ব্যবহার না করে পকেটে মোবাইলে যা নয় তাই গান চালিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে। এখানেও জনা তিনেক ব্যক্তি সকালে মর্ণিং ওয়াক করেন বা জিম করেন পকেটে ভক্তিগীতি চালিয়ে। এমনিতে আমার ভক্তিগীতি নিয়ে সমস্যা নেই। বরং রামপ্রসাদী বা শ্যামাসঙ্গীত আমি সত্যিই পছন্দ করি। কিন্তু চটুল হিন্দি গানের সুরে যদি কেউ মাকে ডাকে তখন সত্যিই ভাবা যায় না যে তিনি বাঘ বা সিংহারূঢ় হয়ে দশভুজা হয়ে বেনারসি বা সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কে মাথায় মুকুট পরে মন্দিরের শোভা বাড়াচ্ছেন। ‘ও ও জানে জানার’ সুরে ‘ও মা শেরাবালি’। না না আর বেশী ভাবতে হবে না।

পাঠক চিন্তা করুন, আপনি হাজার স্টেপস করছেন। তার মধ্যে সাতশো পঞ্চাশতম স্টেপে পৌঁছেছেন। আর আপনার জুড়িদার হিসাবে ওয়াকারের অপর প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন ‘উঠালে মা’ টাইপের এক ব্যক্তি। পকেটে বাজছে ‘ঝুমকা গিরা দে’র সুরে ‘মাকে প্যায়ের ছুলে’ টাইপের গান। কোন একাত্মবোধ আর সংকল্প তখন আপনাকে সাতশো একান্নতম স্টেপের দিকে এগোতে দেবে বলুন দেখি?

তবে সত্যিই কিছু সঙ্কল্পিত ব্যক্তি দেখি। বিশেষত মহিলা। সংসারের জোয়াল আর ঘোমটার ওজনে ঘাড় নুইয়ে পড়ার অবস্থা। কিন্তু সকালটা ঠিক রেজোলিউটলি পার্কে এসে মর্ণিং ওয়াক করছেন অথবা জিমে ঘাড় গুঁজে নিজের ব্যায়াম করে চলেছেন। এই ডেডিকেশন বিরল। গৃহকর্ত্রীরা যেমন নিজের কাজটি শত ঝঞ্ঝাট সত্ত্বেও চালিয়ে যান। সেই একই দৃশ্য তাঁদের ব্যক্তিগত ফিটনেসের প্রতি দেখে আমি আপ্লুত হই।

তবে এক ব্যক্তির গল্প বলে আজকের এই জিম করবেট শেষ করছি।  তখন সবে দিন পাঁচেক হয়েছে জিম করার। এক মনে ওয়াকারে স্টেপস গুনে যাচ্ছি। কখনও কখনও হাফ স্কোয়াট মুদ্রায় পা চালাচ্ছি। এতে ব্যাল্যান্সও বাড়ে আরে পায়ের পেশীও যথেষ্ট স্ট্রেচড হয়। কিন্তু কষ্ট সাধ্য। তাই হয়তো মুখে কাঠিন্য দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। এক ভদ্রলোক, লম্বা মতো, প্রায় টাক ছিল বলে সেটাও কামানো। সামনে বসে জিমের কাঁধের ব্যায়ামটা বিতিকিচ্ছিরিভাবে করছিলেন আর এন্তার বকরবকর চালিয়ে যাচ্ছিলেন। লম্বা আধ হারা চেহারা। ডান কাঁধে মাছি বসলে পিছলিয়ে তর্জনি পর্যন্ত চলে আসবে এমন পেশী বিন্যাস। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে ভাইসাব অ্যায়সে নহি করতে। রিল্যাক্সড হোকে করো!’

আমার তখন রীতিমতো গতি এসে গেছে। ছশো হয়ে গেছে, আরও চারশো। ঘাড় নেড়ে অস্পষ্ট ‘হুঁ’ বলা ছাড়া আমার কিছু করণীয় নেই। কিন্তু তীব্র প্রেশারে এর বেশি ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি দুমিনিট পরে আবার বললেন। এবার তো থামতেই হয়।

থামার পর আমি ওঁর দিকে শান্ত চোখে বললাম, ‘আঙ্কল, তিশ সাল হো গয়ে জিম কর রাহা হুঁ!’ আর কাঁধের ব্যায়ামের অপর প্রান্তে আরেক ব্যক্তি বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দু দিন আগেই আলাপ হয়েছে তিনি নিজের বয়সে এনসিসি ইত্যাদি করেছেন বটে। এখনও মার্জিত ভঙ্গিতে নিজের ব্যায়ামটুকু করেন। তিনি উঠে এসে বললেন, ‘আঙ্কল, কভি তো চুপ কিয়া করো! ঘর মে ভি টিকনে নহি দেতে হো ঘরবালো কো। অউর বাহার মে ভি!’ আঙ্কল ষাট ছুঁই ছুঁই। আমি আঙ্কল বললে এক ব্যাপার কিন্তু সম বয়স্ক কেউ বললে?

ভদ্রলোক চুপ করে নিজেরটুকু না করে কেটে পড়লেন। তারপর থেকে দেখি আমি বা এনসিসি ভদ্রলোক জিমের কাছে থাকলেই তিনি এদিকে ভেড়েন না। কিন্তু অন্য সময়ে জিম নিয়ে আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথ করে বেড়ান। বিচিত্র মানবমন। কোথায় গিয়ে কোন পাকে নিজের জায়গা খুঁজে নেয় কে জানে। বাড়িতে টিকতে দেয় না না পারে না। আবার সকালের পার্কে এসে নিজের মন খুলে বকার একটা জায়গা খুঁজে নেয়। কে জানে! খারাপ লাগলেও সেটাকে সামনে আসতে দিলাম না। সহানুভূতি এখানে ষাঁড়কে ডেকে গুঁতিয়ে দিতে বলার সমান হয়ে যাবে বলে।

সারা দুর্গাপুজোটা খুব বেশি কসরৎ করতে পারিনি। কিন্তু কাল থেকে আবার শুরু করেছি। কালীপুজোয় কলকাতা যাবার আগে শরীরটাকে একটা প্রেজেন্টেবল জায়গায় নিয়ে যেতে তো হয়! দেখলেন তো! বেফাঁস কথা ফাঁস করে দিলাম! যাক গে চলি বুঝলেন! শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।

delhi
Advertisment