Advertisment

দিল্লি লাইভলি: পক্ষ-অন্তর (৩)

দিল্লিতে কাঁঠাল বলতে বোঝে এঁচোড়। কদিন আগেই যাচ্ছিলাম করবেটের রাস্তায়। দুপাশের গাছে গাছে ল্যাংড়া আম, লিচু ছাড়াও দামড়া দামড়া কাঁঠাল ঝুলে রয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- জয়ন্ত মিস্ত্রি

কলকাতা আর দিল্লির মধ্যে একটা বেসিক পার্থক্য আছে। বিশেষত গরমকালে। যদিও উভয় শহরেই রুমালের প্রয়োজন, কিন্তু কলকাতায় শুকনো রুমাল ঘামে ভিজে পকেটে ন্যালপ্যাল করে আর দিল্লিতে জলে ভেজা রুমাল মুখে চোখে মেখে মাথার উপর বাঁধা অবস্থায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

Advertisment

বস্তুত দিল্লির গরম এক অন্যধরণের বিষম বস্তু। কলকাতায় গরমে আপনি সিদ্ধ হয়ে ভেপ্সে যাবেন। কিন্তু দিল্লি আপনাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভুনা কাবাব বানাবে। মাঝে মাঝে গরম হাওয়া ছাড়ে, যারা মুখ বা গলার নিচের খাঁজ খোঁজ খুঁজে দেখে না পোড়া হলে সেটাও রঙ ঘষে দেয়। চোখটাকে চেষ্টা করে কিন্তু লাল অবধিই যেতে পারে, বাদামি হয়ে গেলে হয়তো মানুষ সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বলে।

আরও পড়ুন, দিল্লি লাইভলি: পক্ষ-অন্তর (২)

সেই ওয়াইটুকে ছোঁব ছোঁব বছরে এসে থেকে দেখছি, দিল্লিতে মানুষ ছাতা বার করে শুধুমাত্র ধুলো ঝাড়বার জন্য। বৃষ্টি হবে শুনলে ইচ্ছে করে বাড়িতে ছাতা রেখে যায়। কে জানে এ বছরে আর ভেজার সুযোগ হবে কি না! বৃষ্টি যদিও বা ছাতার কালো কাপড় কখনও সখনও ভেজায়, ছাতার মাথায় রোদের চাষ কখনই নয়। এ যেন সেই জুতা আবিষ্কারের মতো ব্যাপার। হবুচন্দ্র বলছে মাথা ঢাকতে হবে, তো গবুচন্দ্র মন্ত্রী ছাতাফাতার ধার না ধেরে সোজাসুজি ওড়না ব্যবহার করে মাথা গলা মুখ এবং শরীরের উর্ধাঙ্গ ঢেকে নিয়ে বেরোচ্ছে। মে জুন মাসে দিল্লি কেন? সমগ্র উত্তর ভারতের কম বয়সী মেয়েরা নিজের নিজের স্কুটি নিয়ে এক একটা উগ্রপন্থী। মাথা মুখ ঢেকে হাত ঢেকে চোখে রোদ চশমা নিয়ে বের হচ্ছে। সূর্যের দিকে একটা একে ৪৭ তাক করাটা খালি সময়ের অপেক্ষায়।

অবশ্য গরমের সবকিছুই কি খারাপ? এই যে মিষ্টি মিষ্টি আম জাম লিচু কাঁঠাল ফলসা জামরুল কুঁচফল এসব আপনার দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের পর পাতে এসে পৌঁছচ্ছে সেগুলো কোথায় যায়? তার সঙ্গে শীতকালের দুটো কমলা আর তিনটে আপেল কী প্রতিযোগিতায় নামতে পারে? তবে দিল্লিতে কী কী পাওয়া যায় সেটাও একটা কথা। জাম লিচু ছেড়ে দিচ্ছি। আমের ব্যাপারে লম্বাটে দশেরি আর ভ্যাদভ্যাদে সফেদা ছাড়া পাওয়া যায় মরসুমের শেষের ল্যাংড়া। এ ল্যাংড়া মালদার নয়। বেনারসি ল্যাংড়া আকারে এবং ইঙ্গিতে আসল ল্যাংড়ার সঙ্গে একই পঙক্তিতে বসার উপযুক্ত নয়।

আর কাঁঠাল? দিল্লিতে কাঁঠাল বলতে বোঝে এঁচোড়। কদিন আগেই যাচ্ছিলাম করবেটের রাস্তায়। দুপাশের গাছে গাছে ল্যাংড়া আম, লিচু ছাড়াও দামড়া দামড়া কাঁঠাল ঝুলে রয়েছে। ছেলেছোকরাদের দেখা নেই! এ দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। সুবোধ বালকেরা ফ্রিজে রাখা ঠাণ্ডা আম খাবে কিন্তু গাছে চড়ে কাঁচা মিঠে নামিয়ে বিটনুন দিয়ে খাবার বিষয়ে তীব্র অনীহা।

অবশ্য এই ভ্যাপসা স্বাদের আম সম্বল করেই দিল্লি বা উত্তর ভারত আমের শহরে একটা আম পানীয় রপ্তানি করে ফেলল। ছেলেবেলায় কলকাতার রাস্তায় ম্যাঙ্গো জ্যুস খেয়েছি কিন্তু এই যে আজকাল কলকাতায় হুট বলতে ম্যাঙ্গো লস্যি বা ম্যাঙ্গো শেকের দোকান খুলে কাঁচা দুধ বা তাজা দইয়ের সঙ্গে দরকচা মার্কা আম আর এক খাবলা চিনি বরফের সঙ্গে মিক্সি মেরে আইসক্রিমের স্কুপ আর ড্রাইফ্রুটস দিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সে সব এই মেড়ো খোট্টাদের দেশেরই দান। আমরা এখানে যা খেয়ে নাক সিঁটকিয়ে কলকাতার সোনার দিনগুলোর কথা ভেবে বুক চাপড়াই, নব্য কলকাতা সেগুলোকেই দেখছি বুকে তুলে নিচ্ছে।

আরে দেখুন দেখি। আড্ডা শুরু হয়েছিল রুমাল নিয়ে এখন তা ফসকে গিয়ে বিড়াল হয়ে বসে আছে। সে যাকগে আজকের এই রুমালের মিসফায়ার হওয়া গল্প শেষ করি দুটো গল্প দিয়ে।

এক, সে সবে এসেছি দিল্লিতে। কলকাতার এটিকেটটা তখনও চিবুকের তলায় সদ্যোজাত গোটির মতো ঝুলছে। এসে জেনেছি যে বাসে এখানে কন্ডাক্টর আপনার কাছে এসে টিকিট চাইবে না। আপনাকেই দিতে হবে। না হলে চেকার মাঝরাস্তায় উঠলে ঘেঁটি ধরে নিয়ে যাবে। তা আমি প্রথম গেট দিয়ে উঠে একটা সীট পেয়ে তাতে বসে, তারপর সেখানে পকেটের রুমাল বার করে রেখে গেছি পাঁচটাকার টিকিট কাটতে। যাব সরোজিনী নগর, আশ্রম থেকে। ফিরে এসে দেখি, এক জাঠ তনয় আমার রুমাল সীট থেকে তুলে জানলার কাছে পাট করে গুছিয়ে রেখে সেখানে বসে পড়েছে। দুতিনটে ভালোমন্দ কথা শুনিয়ে দেখলাম সেগুলো নিত্য দিনের পান বা গুটখার মতো সে হজম করে ফেলল।

আর দুই, এটা সত্যিই ছিল রুমাল আর হয়ে গেল বেড়ালের গল্প। তখন ডেস্কে ডেস্কে কম্পিউটার আসেনি। একগাদা ফাইলের মধ্যে হাঁসফাঁস করার দিনগুলি। তা ফাইল বার করার জন্য আলমারি খুলে তারপর ঘাম মুছে রুমালটা পকেটে রাখতে ভুলে গিয়ে আলমারিটা খোলা অবস্থায় রুমালটা তার দ্বিতীয় তাকে রেখে বাড়ি চলে গেছিলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। সোমবার ফিরে এসে দেখি চারটে চোখ না ফোটা বেড়াল বাচ্চা রুমালটার অপ্রতুলতায় ভয়ানক বিব্রত হয়ে ‘মিউ মিউ’ করছে। রুমাল তো আর ফিরে আসবে না, কিন্তু আগামী দু সপ্তাহ সেই আলমারি আর খুলতে পারিনি বা কাউকে খুলতেও দিইনি। পাছে বেড়ালগুলো আবার রুমাল হয়ে যায়!

বৃষ্টি আসুক বিকেল জুড়ে, আবার দেখা হচ্ছে তাহলে!

Advertisment