সময়
সময় কারুর জন্যই থেমে থাকে না। সে চলে নিজের গতিতেই। তবে এই সূত্রেই মনে পড়ল, আমার একটি ভয়ানক বাজে অভ্যাস আছে, মানে আমি ইন্ডিয়ান স্ট্যাণ্ডার্ড টাইমে চলি না। আমার কাছে পাঁচটা মানে পাঁচটাই। আর এর ফলে, আমি কোথাও যেতে হলে সময়ে পৌঁছিয়ে যাই কিন্তু বাকি লোকজন যদি না আসে আর কাজটা যদি সময়ে না শুরু হয় তাহলে বেমক্কা মাথা গরম হতে থাকে। শেষে সম্পর্ক খারাপ থেকে ইতি। এমন সব ভয়ঙ্কর ফলাফলের জন্যই এটাকে বাজে অভ্যাস যদি বলি তাহলে ভুল বলি কি বলুন?
এই যে কদিন আগে আধারকার্ডের সঙ্গে বায়োমেট্রিক মিলিয়ে সরকারিকর্মচারীদের আসা যাওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হল, তাতে কী হল? ছাড়া গরু বাঁধা পড়ল, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল আর কাকীমার সিরিয়ালকেলি বন্ধ হল? না না সেসব বললে চলে? বায়োমেট্রিকে বেঁধে অথবা বিঁধে সরকারীবাবুকে আসা যাওয়ার সময়ে তো ধরে ফেললেন, কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি? আর সরকারি ক্ষেত্রে তো সেসবের বালাই নেই, আপনার সিনিয়ারিটির বিচারেই প্রোমোশন আর উচ্চতর স্তরে, আপনার তেলের কুপির মাপের উপর প্রোমোশন বা কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট টিকে থাকে।
যদি কেউ ভালো কাজ করে তার তো আলাদা করে কিছু পাওনা নেই। তাহলে সে করে কেন? প্রশ্ন বটে, প্রত্যেক ক্রিয়ার এক সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। আর প্রতিক্রিয়া হিসাবে অর্থই হলও সর্বোত্তম। কিন্তু অর্থ ছাড়াও যদি মান, যশ, সম্মান, প্রতিপত্তি ইত্যাদিরা আপনার বাড়ি বয়ে আসে তাহলেও ঘোলে মিটিয়ে নেবেন। কিন্তু আর কিছু বললে পাঠক পাঠিকারা অবাক চোখে চাইবেন! তা হল কার্মিক সন্তোষ বা জব স্যাটিসফ্যাকশন। সরকারিঅফিসে কাজ করে যদি আপামর না হলেও কিছু মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন তাহলে তো কেয়াবাত।
অবশ্য ভালো খারাপ বলতে পারব না কিন্তু গল্প প্রচুর তৈরী হয়েছে এই বয়োমেট্রিকের ফলে। এই যেমন আগেকার দিনে যারা হেলতে দুলতে সাড়ে এগারোটায় অফিসে এসে এক কাপ চা খেয়ে বসতে না বসতেই লাঞ্চ হয়ে যেতো আর লাঞ্চের পরে এক রাউণ্ড শাস্ত্রী ভবন বা কৃষি ভবন চক্কর মারার পর বিকেল তিনটে হতেই চা খেতে যেতো আর চা খেতে খেতেই সাড়ে চারটে বেজে গেলে চার্টার্ডের সময় হয়ে যাওয়া ফাঁকিবাজগুলো ট্যাংট্যাঙে সকাল সাড়ে নটার আগেই যখন অফিসের দেওয়ালে লাগানো কালো বাক্সটায় বুড়ো আঙুল টিপে বসে থাকতে দেখি তখন কোথাও না কোথাও মজা তো লাগেই।
এক এক অফিসের আবার এক এক নিয়ম। নির্মাণ ভবনের এক মন্ত্রী আবার যুগ্ম সচিব থেকে শুরু করে পিওনের বসার জায়গার উপরে নাম লিখিয়ে রেখেছিলেন। আর সকাল নটায় নিজে চেক করতেন যে সবাই এসেছে কি না! ভদ্রলোকের এখন আরও একটু উঁচু পোস্টে পদোন্নতি হয়েছে। সেই সব পদ, যেগুলি সংবিধান রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘর সাজাবার জন্য সৃষ্টি করেছে, তার একটি। কিন্তু সেখানে গিয়েও তিনি সেই তিন চারে বারোর মতো একই কাজে মন দিয়েছেন। তাতে আর কিছু না হোক সংসদীয় পদমর্যাদার বিশাল শোভাবৃদ্ধি হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তা সব তো গেল অফিসকাছারির কথা। কিন্তু আমজীবনে যদি সময়জ্ঞান নিয়ে সমস্যা হয় তাইলে? বিকেল পাঁচটায় আপনার গার্লফ্রেণ্ড কথা দিয়ে বলে গেছে আসিবে কুতুবের কাছের সিসিডিতে। আর পাঁচটায় গিয়ে দেখলেন আপনি আর ওয়েটার ছাড়া কেউ নেই! এক কাপ দু কাপ তিন কাপ! ক্যাফিনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ওদিকে ম্যাডামের দেখা নেই! আর অনেক কিছুর মতোই মোবাইল ফোন মানুষকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করে।
আগেকার জমানাই ধরুন, তখন আমি গার্লফ্রেণ্ডের সঙ্গে দেখা করতাম শ্যামবাজারের মোড়ে। একটা ফোন বাবার গণ্ডি পেরিয়ে ঠিক তিনটেয় পৌঁছে গেছে তার কাছে। সেও বলেছে পাঁচটা। কিন্তু ঘড়ি ঘুরে ছটায় এসে হাজির। পাঁচটা ‘সরি’র পিছনে একটা ‘ঠিক আছে’তেই সিচুয়েশন ম্যানেজ হয়ে গেল।
কিন্তু যে আপনি পাঁচটার সময় মোবাইলে ফোন করেছেন, ওপার থেকে ভেসে আসবে, “ওরেবাবা কি জ্যাম রে বাবা!” তার দশ মিনিট পরেও, “উফ আর পাঁচ মিনিট!” সেই পাঁচ মিনিট পেরিয়ে পঁয়তাল্লিশ হলে জানতে পারবেন যে যে পাঁচটায় আপনি সিসিডির প্রফিট বাড়াতে প্রবেশ করেছিলেন, অপর প্রান্ত হয়তো সেটাকেই বাড়ি থেকে বেরোবার সময় হিসাবে ইস্তেমাল করেছে। সে যা হোক এটা উল্টো ক্ষেত্রেও সত্যি হয়। আর সেক্ষেত্রে যদি মেয়েটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তো সত্যি বলছি, মানুষের ইমান ধরম নিয়ে আমার মনেই প্রশ্ন উঠে যায়। সে যতই সেক্সিস্ট বলুন না কেন। একটা মেয়ে এক ঘন্টা ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে আর রুক্ষুমুক্ষুশুক্ষু দিল্লির আমপাবলিক কিস্যুটি বলবে না তা কি হয়?
সে যা হোক, প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে সময় সংক্রান্ত তিন চারটে গল্প বলে আজকের মতো শেষ করি। সালটা বোধহয় দুহাজার চার। বার্ষিক বাড়ি যাবার সময় উপস্থিত হয়েছে। শিয়ালদা রাজধানী ছাড়বে পৌনে পাঁচটায়। তখন থাকতাম আশ্রমের একটা রেলগাড়ির কামরার মতো ফ্লোর বা ফ্ল্যাটে। সে নিয়ে পরে নাহয় কোন একদিন। তা সেখান থেকে নিউদিল্লি স্টেশন মাত্র আট কিমি, হরে দরে আধ ঘন্টা। তা সে হিসাবেই হিসাব করে বেরচ্ছিলাম পৌনে তিনটেয়। কিন্তু আমার দু বছরের পুত্রটি দিল ফ্লাস্ক ফেলে ভেঙে। ব্যাস নতুন ফ্লাস্ক ধুয়ে জল গরম করে ভাঙা কাঁচের টুকরো তুলে বেরতে বেরতে সাড়ে তিনটে। তারপর নিজামুদ্দিনের কাছে এক ওয়ান লেন আণ্ডার পাস দিয়ে আসতে গিয়ে ঝাড়া কুড়ি মিনিট। তারপর আট কিমির মোট নটি রেড লাইটে দু মিনিট করে দাঁড়ানো। সহযাত্রিনীর অবস্থা টাইট। আমিও গুণে যাচ্ছি ঘড়ি, ব্যাক ক্যালকুলেশনে। কুড়ি মিনিট আগে পৌঁছব, পনেরো মিনিট আগে পৌঁছব, দশ, পাঁচ এসব করে দেখি মাইনাসে চলছি। শেষে অটোচালকের অদম্য কুশলতায় আর স্বতঃপ্রণোদিত এক কুলিভাইয়ের অশেষ সহায়তায় কামরায় উঠতেই দেখলাম ট্রেন ছেড়ে দিল। স্টুডিওর ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজতে পাঁচ। ভাগ্যিস তখনও ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমে ট্রেন ছাড়ত।
এরকমই একবার আশি সালে কলকাতা থেকে দেরাদুন যেতে গিয়ে হ্যারিসন রোডের রাম্বা জ্যামে ফেঁসে শেষে বাবার কোলে চেপে হুগলী নদী পেরিয়ে (আরে ব্রিজ দিয়ে মশায়! আমার বাবার নাম বিদ্যাসাগর নয়!) ট্রেন ছাড়ার কুড়ি মিনিট পরে স্টেশনে ঢুকেও ট্রেন পেয়ে গেছিলাম দুন এক্সপ্রেস দেরী করায়।
সে যাকগে গিয়া, সময় এগিয়েছে। আর আমিও পাল্লা দিয়ে অফিশিয়াল সফরে বিমান ব্যবহার করি আজকাল। তা আমার মন্ত্রণালয়ের এক খাড়ুশ সচিবের পাল্লায় পড়ে একবার বিনা নোটিশে পরের দিন সকালেই জেট এয়ারওয়েজ ধরার ছিল গৌহাটির জন্য। কথা ছিল আমি গিয়ে ঝাঁট টাঁট দিয়ে রাখব আর তিনি এসে আসন গ্রহণ করবেন। কিন্তু সক্কাল সক্কাল এয়ার ইন্ডিয়ার কোন ফ্লাইট নেই, আছে জেটে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের এয়ার ইণ্ডিয়াকে ডকে তোলার মরিয়া প্রচেষ্টার অন্তর্গত হয়ে এতদিন ধরে এয়ার ইণ্ডিয়াতেও সফর করে আসছি। তারা তো বিমানে ওঠার সময় পেরিয়ে গেলেও লাল গোলাপ নিয়ে বসে থাকে। ঘুম থেকে তুলে গোলাপ হাতে ধরিয়ে মুখ মুছিয়ে চুল আঁচড়িয়ে প্লেনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু জেট ফেট এসব ব্যাপারে তথাকথিত প্রফেশনাল, আদতে বাজারি। তখন চলছিল দিল্লির অড ইভেনের মরসুম। ফলে যে ট্যাক্সি বলে রাখা ছিল সে ইভেন হওয়ায় অড দিনে সমস্যায় পড়ে আবার নতুন গাড়ি বুক করে উড়ে এসেও প্লেন ছাড়ার এক ঘন্টা আগে পৌঁছতে পারিনি। আর প্রাইভেট এয়ারলাইন্স তো কাকা এসব দিনেরই অপেক্ষায় থাকে। ওয়েটলিস্টেড যাত্রীকে আমার অবর্তমানে বর্তমান ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আমার ভবিষ্যৎ ঝরঝরে করে দিয়েছে। অনেক অনুরোধ উপরোধেও কিছু কাজ হয় না। শেষে পরের ফ্লাইটে যখন উঠতে যাচ্ছি বেশী ভাড়া দিয়ে, দেখি মূর্তিমান যমদূতের মতো সেই অশ্বেতর সচিব মহোদয় দাঁড়িয়ে আমার ঠিক সামনেই। বাকিটা বলার দরকার নেই। সম্পূর্ন অফিশিয়াল বার্তালাপ! কিন্তু আমার জন্য সেই আলাপ ঝালা বার করে দিয়ে তবলায় তেহাই বাজিয়ে দিয়েছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর শেষ গল্পটা আমার নয়, আমার পার্শ্ববর্তিনীর। এটা লেজেন্ডারি পর্যায় পড়ে। তিনি তাঁর জার্মান বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কলকাতা ঘুরতে আসছিলেন। শূন্য দশকে একটা বোম্বাস্টিক ট্রেন ছিল হাওড়া দিল্লি এক্সপ্রেস বলে। দিল্লি এলে দিল্লির নামে আর হাওড়া এলে...। তা সেই ট্রেন প্রায় সাড়ে চব্বিশ ঘন্টা নিত এদিক ওদিক করতে। তিনি কলকাতা পৌঁছোবার সময়টিকে যে কোন কারণেই হোক ছাড়ার সময় ধরে শেষে প্রায় শেষ মুহুর্তে জানতে পেরে হুড়মুড়িয়ে প্ল্যাটফর্ম নম্বর চৌদ্দয় পৌঁছে আবিষ্কার করলেন তাঁর সামনে দিয়েই প্ল্যাটফর্ম নম্বর বারো থেকে হাওড়া এক্সপ্রেস ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সময়টা ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন বটে। কিন্তু প্ল্যাটফর্মটা?