Advertisment

জাগ্রত মৌলীক্ষা মন্দির! ভক্তদের দাবি, পূরণ হয় মনস্কামনা, ঘটে বহু অলৌকিক ঘটনাও

কলকাতা থেকে একদিনেই ঘুরে আসা যায়। দুপুরে অন্নভোগ আর রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও আছে।

author-image
Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Devi Mouleekhhya Temple 1

দেবী মৌলীক্ষা ও তাঁর মন্দির

কলকাতা থেকে ২১৩ কিলোমিটার দূরে বীরভূমের রামপুরহাট জংশন। স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে এলে মিলবে টোটো স্ট্যান্ড। সেখান থেকে টোটো নিয়ে যাওয়া যায় দেবী মৌলীক্ষার মন্দির। ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব সীমান্তে ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলায় মলুটি গ্রাম। সেখানেই দেবীর মন্দির। রামপুরহাট স্টেশন থেকে যার দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। টোটোয় চেপে যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। টোটো ভাড়া নেয় ১২০ টাকা। টোটোয় যাত্রাপথে রাস্তার দু'পাশে পড়বে ঘন মহুলবনের জঙ্গল। যা, রীতিমতো মন কাড়বে। ১৭৯০ সালে এক ইংরেজ আধিকারিকের রিপোর্ট অনুযায়ী, আগে এখানে বাঘ-ভাল্লুক ছাড়াও বুনো হাতির ব্যাপক উপদ্রব ছিল। যার জেরে পার্শ্ববর্তী প্রায় ৫৬টি গ্রাম চিরতরে জনশূন্য হয়ে যায়। তারই মধ্যে কঠোর সংগ্রাম করে টিকে গিয়েছিল সাঁওতাল অধ্যুষিত কিছু গ্রাম। যার অন্যতম পাতরাঙ্গা। পথেই পড়বে। এই গ্রামের কাছেই রয়েছে আদিবাসীদের জাগ্রত সর্পদেবী নাগকাটির মন্দির।

Advertisment
publive-image

আগে এই অঞ্চল ছিল বিহারে। পরিচিত ছিল সাঁওতাল পরগণা নামে। মলুটি অঞ্চল তারই অংশ। আগে এখানে মহুল গাছের জঙ্গল। সেই জঙ্গল কেটে গ্রাম গড়ে উঠেছিল বলেই গ্রামের নাম হয়েছে মহুলটি। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে মলুটি। আবার ভিন্নমতে দেবী মৌলীক্ষার নাম থেকেই জায়গাটির নাম হয়েছে মুলুটি। দেবীর নাম মৌলীক্ষা, তার কারণ হল- 'মৌ' শব্দের অর্থ মস্তক বা মাথা। আর, 'ঈক্ষা' শব্দের অর্থ- দর্শন বা দেখা। কথিত আছে দেবী মৌলীক্ষার এই ধড়হীন মূর্তির সাধনা করতেন বৌদ্ধ তান্ত্রিক বজ্রযোনি। সেটা খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর ঘটনা। ছোট এই গ্রামের দু'দিক থেকে বয়ে গিয়েছে দুটি ক্ষীণস্রোতা নদী- চন্দননালা এবং চুমরে। এখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক তথা স্থানীয় বাসিন্দা গোপালদাস মুখোপাধ্যায়। যা থেকে জানা গিয়েছে, এখানে কয়েক হাজার বছর আগেও মানুষ বাস করতেন। মধ্যযুগে রাজা বসন্ত রায়ের প্রতিষ্ঠিত নানকর বা করমুক্ত রাজ্য মলুটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।

publive-image

রাজারা বাস করতেন গ্রামের মাঝখানে দোতলা মাটির বাড়িতে। তার চারপাশে তাঁরা একের পর এক মন্দির তৈরি করেছেন। যা কাশীধামের সঙ্গে তুলনীয়। সেই কারণে এই গ্রাম একসময় পরিচিত ছিল 'গুপ্তকাশী' নামে। যদিও অনেকে বলেন, তেমনটা নয়। তার বহু আগে, ১৮৫-১৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ বিহার-কেন্দ্রিক মগধ সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল শুঙ্গ রাজবংশ। সেই সময় থেকেই মলুটি গ্রাম পরিচিত ছিল গুপ্তকাশী নামে। কথিত আছে, ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এখানকার নানকার রাজপরিবারের সদস্যরা চারটি পরিবারে বিভক্ত হয়ে যায়। তারপরই নিজেদের মধ্যে শুরু হয় মন্দির তৈরির প্রতিযোগিতা। মোট ১০৮টি শিবমন্দির গড়ে উঠেছিল। কালের প্রবাহে যার অনেকগুলোই আজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে অবশিষ্ট আছে শিব-দুর্গা-কালী-সহ বিভিন্ন দেবদেবীর ৭২টি মন্দির। যার মধ্যে ৫৭টি আবার বাংলার চারচালা ঘরানার। প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে টেরাকোটার অসাধারণ কাজ। যার বিষয়বস্তু পুরাণ, কৃষ্ণলীলা, মহাভারত, রামায়ণের কাহিনি, আদিবাসী জীবন এমনকী ব্রিটিশ বন্দুকধারী সৈনিকও সেই অলংকরণে ফুটে উঠেছে।

publive-image

দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে স্বাগত জানাবে কারুকার্যময়, অত্যন্ত সুন্দর এক বিশালাকৃতির তোরণ। দু'পাশে গাছগাছালি এবং মধ্যে ঢালাই রাস্তা দিয়ে সোজা গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরে। মূল মন্দিরের আগে রয়েছে বিরাট আকারের নাটমন্দির। তারপর কয়েক পা এগোলে দেবীর গর্ভগৃহ। দেবীর মূল মন্দিরটি দেখতে অনেকটা তারাপীঠের মন্দিরের মত। বাংলার দোচালা স্থাপত্য রীতি মেনে তৈরি। মন্দির পশ্চিমমুখী। মন্দিরের বাঁদিকে আছে দুটো ষজ্ঞবেদী। মন্দিরের ডানদিকে পুরাতন স্থাপত্যের নির্দশন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক শিবমন্দির। যার শিবলিঙ্গটি বহু প্রাচীন। তার পাশে রয়েছে বামাক্ষ্যাপার সাধনকক্ষ। কথিত আছে, বামাক্ষ্যাপা এখানে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তারপর তারাপীঠে গিয়েছিলেন। দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরের পাশে রয়েছে মানতবৃক্ষ। যেখানে ভক্তরা পাথরের টুকরো সুতোয় বেঁধে মানত করে যান। মন্দিরের বাঁদিকে বহু পুরোনো এক গাছের নীচে বেদীর ওপর আছে সুপ্রাচীন কিছু দুষ্প্রাপ্য মূর্তি। ভক্তরা যাকে ষষ্ঠীতলা বলেই জানেন। দেবী মৌলীক্ষার গর্ভগৃহে মূর্তির পাশেই আছে এক পাথরখণ্ড। যার অবয়ব অনেকটা ধ্যানমগ্ন মূর্তির মত। ভক্তরা এই পাথরের খণ্ডকে কালভৈরব রূপে পুজো করেন। মুলুটি গ্রাম, যেখানে দেবীর মন্দির, সেখানকার নানকর রাজপরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের নাম।

publive-image

১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওড়িশার কটক আক্রমণ করেছিলেন। সেই সময়ে ওড়িশার গজপতি সাম্রাজ্যের শাসক মহারাজা প্রতাপরুদ্র প্রতিহত করেছিলেন হুসেন শাহর আক্রমণ। অসফল হুসেন শাহ বীরভূমের মধ্যে দিয়ে গৌড়ে প্রত্যাবর্তনের সময় ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে মলুটি গ্রামের কাছাকাছি তাঁবু ফেলছিলেন। কথিত আছে, সেই সময় সুলতানের প্রিয় এক বেগমের পোষা বাজপাখি সোনার শিকল কেটে পালিয়ে গিয়েছিল। যাতে বেগম রীতিমতো মুষড়ে পড়েন। সেই সময় সুলতান হুসেন শাহ ঘোষণা করেছিলেন যে বেগমের পাখি ধরে দিতে পারবেন, তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। সেই ঘোষণা শুনে স্থানীয় হতদরিদ্র রাখাল বালক বসন্ত রায় ফাঁদ পেতে বেগমের শখের বাজপাখিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাদশাহের কাছে। তাঁর কর্মকৃতিত্বে খুশি হয়ে হুসেন শাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার পরদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বসন্ত রায় ঘোড়ায় চেপে যতদূর পর্যন্ত যেতে পারবেন, ততটা নিষ্কর জমি নবাব তাঁকে দান করবেন। শোনা যায়, বাদশা তাঁর কথা রেখেছিলেন। ঘোড়ায় চেয়ে ঘুরে আসা জঙ্গলে ভরা প্রায় ১৬ কিলোমিটার ব্যাসের নিষ্কর জমি বসন্ত রায়কে নবাব দান করেছিলেন। দিয়েছিলেন রাজা উপাধিও। সেই থেকে বসন্ত রায় পরিচিত হন 'রাজা বাজবসন্ত' নামে। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল নানকর বা করমুক্ত রাজ্য। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে মলুটি সুবা বাংলার এক অঞ্চলে পরিণত হয়। তখন মলুটিতে রাজত্ব করতেন নানকার বংশের রাজা রাখরচন্দ্র রায়।

publive-image

কথিত আছে, রাজা একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নাদেশে দেবী তাঁকে বলেন, 'আমি দেবী মৌলীক্ষা। মা দুর্গার এক রূপ। মলুটি গ্রামের জঙ্গলে ভাঙা মন্দিরের গর্ভগৃহে আমি বহু বছর অযত্নে আছি। অসহায় মানুষের মঙ্গলার্থে আমাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা কর।' সেই স্বপ্নাদেশের পর রাজা কুলোপুরোহিত দণ্ডিস্বামীকে নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখতে পান, সেখানে ভগ্নপ্রায় একটি মন্দির আছে। সেই মন্দিরের গর্ভগৃহে আছে দেবী মৌলীক্ষার মূর্তি। তিনি সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা রূপে পূজিতা হন। দেবীমূর্তি প্রাচীন লাল ল্যাটেরাইট পাথরে তৈরি। দেবীর কারণেই নানকর রাজারা ছিলেন শক্তিমন্ত্রে বিশ্বাসী। দুর্গাপুজোর পাশাপাশি এখানে কার্তিক মাসে দেবী দক্ষিণাকালীর পুজোও বেশ ধূমধাম করে হয়। এখানে আজও বলি প্রথা প্রচলিত আছে। সাধকদের একাংশের দাবি, দেবী মৌলীক্ষার সঙ্গে দেবী তারার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ইতিহাসবিদদের একাংশ দেবী তারাকে দেবী মৌলীক্ষার মতই বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের দেবী বলে দাবি করেছেন। আবার, অন্য সম্পর্ক সূত্র অনুযায়ী, মলুটির রাজা রাখরচন্দ্র রায় একবার তারাপীঠের মন্দিরের দেবী তারার সামনে ধ্যানে বসেছিলেন। শোনা যায়, সেই সময় তারাপীঠ মন্দিরের পুরোহিত এবং পান্ডারা তাঁকে বাধাদান করেছিলেন। রাজাকে তাঁর আসন থেকে তুলে পুজোপাঠ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাতে বাধ্য হয়ে রাজা মন্দির ছেড়ে চলে এসেছিলেন দ্বারকা নদীর পশ্চিম পাড়ে। কথিত আছে, সেখানেই তিনি ঘট প্রতিষ্ঠা করে দেবী তারার পুজো করেছিলেন। তারপর ফিরে যান মলুটি গ্রামে।

আরও পড়ুন- চোখের সামনে অলৌকিক ঘটনা! সাক্ষী ভক্তরা, কামনা নিয়ে ছুটে আসেন এই মন্দিরে

প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, সেই রাতেই তারাপীঠ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে দেবী তারা স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'রাজা রাখরচন্দ্র আমার পরম ভক্ত। সে বড় অভিমান করে চলে গিয়েছে। এবার থেকে পুজোর সময় আমার মুখ যেন পশ্চিম দিক করে বসানো হয়। কারণ, মলুটির মৌলীক্ষা মন্দিরে রয়েছেন আমার বড় বোন।' সেই থেকে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে চতুর্দশীতে দেবী তারার আবির্ভাবের দিন পুজোর সময় দেবীর মুখ পশ্চিমদিক করে দেওয়া হয়। কারণ, মলুটির মৌলীক্ষা মন্দির রয়েছে তারাপীঠের পশ্চিমে। ১৮৫৭ সালে তারাপীঠের মহাসাধক বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় ওরফে বামাক্ষ্যাপা ১৮ মাস দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরে ছিলেন। সাধনভজন করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও দেবী মৌলীক্ষার মন্দিরে আছে বামাক্ষ্যাপার ব্যবহৃত ত্রিশূল। আর, বিরাট আকারের এক শঙ্খ। ভক্তদের অনেকের দাবি, তারাপীঠে থাকাকালীন বামাক্ষ্যাপা প্রায়ই বলতেন মলুটির দেবী মৌলীক্ষা হলেন দেবী তারার বড় বোন। আর, দেবী তারা হলেন দেবী মৌলীক্ষার ছোট বোন। কথিত আছে, বিভিন্ন সময়ে বহু সাধক মলুটি গ্রামকে তাঁদের সাধনার লীলাক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আদি শংকরাচার্যও নাকি কাশী বা বারাণসী যাওয়ার পথে মলুটি গ্রামে এসেছিলেন। এখান থেকেই নাকি তিনি বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী হিন্দু জাগরণ আন্দোলনের সূচনা করেন। এই মন্দিরে আসা ভক্তদের জন্য দুপুরে সামান্য মূল্যে অন্নভোগের ব্যবস্থা আছে। থাকতে চাইলে রাতে থাকারও ব্যবস্থা আছে। এজন্য যোগাযোগ করতে হয় মৌলীক্ষা মাতা সেবা সমিতির ৭০৪৭১৭৬১৫০ নম্বরে। ভক্তদের একাংশের দাবি, আজও নাকি এই মন্দিরে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

Temple Hindu Temple Tarapith Temple durga Kali Temple
Advertisment