Advertisment

পৌষ থেকে মাঘ সংক্রান্তি, ঢাকের তালে নৃত্য করেন দেবী, মন্দিরেই থাকতে হয় ঢাকিকে

বহু অলৌকিক কাহিনি জড়িয়ে এই মন্দিরের সঙ্গে।

author-image
Chinmoy Bhattacharjee
New Update
Satepeeth Yogadya 1

প্রতিবছর এখানে মেলা বসে।

পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানা এলাকা। এখানেই রয়েছে মহাতীর্থ ক্ষীরগ্রাম। ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। কথিত আছে, সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল এখানে। ক্ষীরগ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যোগাদ্যা। বছরভর দেবী থাকেন মন্দিরের পাশেই ক্ষীরদিঘির জলে। ভক্তদের দাবি, নিশুতি রাতে দেবী যোগাদ্যা এখানে ঢাকের তালে নৃত্য করেন। ভক্তদের কাছে, তিনি দেবী দুর্গারই এক রূপ।

Advertisment

বাল্মিকী রামায়ণ অনুযায়ী, দেবী যোগাদ্যার বাস ছিল পাতালপুরীতে। সেখানে দেবী পূজিতা হতেন ভদ্রকালী রূপে। তিনি ছিলেন রাবণের ছেলে মহীরাবণের আরাধ্যা। কথিত আছে পাতালেশ্বরী দেবী যোগাদ্যাকে তুষ্ট করার জন্য মহীরাবণ নরবলি দিতেন। রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় মহীরাবণ রাম-লক্ষ্মণকে বন্দি করে পাতালপুরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলি দেওয়ার জন্য। কিন্তু, হনুমানের কৌশলে সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। উলটে মহীরাবণ এবং অহিরাবণকেই দেবী যোগাদ্যার সামনে বলি দেওয়া হয়।

কথিত আছে, সেই সময় হনুমান যখন রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, সেই সময় দেবী যোগাদ্যা মুখ খোলেন। তাঁকেও পাতালপুরী থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হনুমানকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে দেবী জানিয়ে দেন, মর্ত্যে যেখানে তাঁকে নিয়ে হনুমান পৌঁছবেন, সেটাই হবে দেবী যোগাদ্যার পীঠস্থান। সেই মত ক্ষীরগ্রামে পৌঁছে দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন সেখানকার রাজা হরি দত্তকে। তাঁকে ধূমধাম করে পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ক্ষীরগ্রামে খুব ধূমধাম করে দেবী যোগাদ্যার পুজো হয়। সারাবছর দেবী থাকেন ক্ষীরদিঘির জলে। ৩১ বৈশাখ দেবী যোগাদ্যার বাৎসরিক মহোৎসব। সেদিন ভোরে দেবীকে জল থেকে তোলা হয়। চলে পূজাপাঠ। তারপর দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর উত্থান মন্দিরে। সেই মন্দিরে ২৪ ঘণ্টা থাকার পরদিন দেবীকে ফের ক্ষীরদিঘির জলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পুজো উপলক্ষে ক্ষীরগ্রামে বড় মেলা বসে।

আরও পড়ুন-জাগ্রত দেবী মঙ্গলময়ী, কোন টানে যেন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য ভক্ত

বৈশাখ সংক্রান্তি ছাড়াও ৪ জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় নবমী, বিজয়া দশমী, মকর সংক্রান্তিতে দেবীকে ক্ষীরদিঘি থেকে তুলে পুজো করা হয়। প্রত্যেক পুজোর পরই দেবীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ক্ষীরদিঘির জলে। প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তি অতীতে কোনওভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র রায় ক্ষীরগ্রামে দেবী যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করে দেন। পাশাপাশি, দাঁইহাটের প্রস্তরশিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে একটি দশভুজা মহিষমর্দ্দিনী মূর্তি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- এই মন্দির থেকে খালি হাতে ফেরেন না ভক্তরা, জাগ্রত দেবী সর্বমঙ্গলা

সেই মূর্তিও সারাবছর ক্ষীরদিঘির জলেই থাকত। শুধুমাত্র জল থেকে ৩১ বৈশাখ তোলা হত। এরপর ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গে উঠে আসে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো যোগাদ্যা মূর্তি। তারপর গ্রামবাসীদের আর্থিক সাহায্যে তৈরি হয় নতুন একটি মন্দির। সেই মন্দিরে ফিরে পাওয়া আসল মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে বৈশাখ সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই দেবীর আরাধনা চলে।

আরও পড়ুন-বাংলার অন্যতম সতীপীঠ, যেখানে চৈতন্যপূর্ব যুগ থেকেই ভিড় করেন অসংখ্য ভক্ত

এই মন্দির আর ক্ষীরদিঘির কিছুটা দূরেই রয়েছে ধামাস দিঘি। কথিত আছে, এই দিঘির ঘাটে বিবাহিত কন্যার বেশে দেবী এক শাঁখারির থেকে শাঁখা পরেছিলেন। আর, জল থেকে শাঁখাপরা হাত তুলে তাঁর পুরোহিতকে শাঁখা পরার প্রমাণ দেখিয়েওছিলেন। সেই থেকে প্রতি ৩০ বৈশাখ সধবা মহিলারা এই ঘাটে শাঁখা পরেছিলেন। পাশাপাশি, তাঁরা দেবীকে নতুন শাঁখাও নিবেদন করেন।

আরও পড়ুন-ভক্তদের দাবি দৃষ্টিহীন পেয়েছেন দৃষ্টিশক্তি, সুস্থ হয়েছে মানসিক রোগ, মন্দিরে বাড়ছে পুণ্যার্থীর ভিড়

দেবী যোগাদ্যা থাকায় এই গ্রামে কোনও দুর্গাপুজো হয় না। ঢাকের পরিবর্তে পুজোয় মাদল বাজে। ভক্তদের দাবি, শীতকালে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলে দেবী এখানে ঢাকের তালে নৃত্য করেন। পৌষ থেকে মাঘ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই প্রথা চলে। শীতের সময় গ্রামের প্রধান ঢাকিকে লাল কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে ঢাকি বোল তোলেন। আর, দেবী তাঁর সামনে নৃত্য করেন। এই প্রথা শুরুর সময় ঢাকি গঙ্গাস্নান করেন। পৌষ সংক্রান্তি থেকে মাঘ সংক্রান্তি, এই একমাস ঢাকি মন্দিরেই থাকেন।

Kali Puja Durga Puja pujo
Advertisment