রাজ্যের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র দীঘা। সেই দীঘার সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে নানা স্বপ্ন দেখছে রাজ্য সরকার। পর্যটকদের ভীড় বাড়াতে লাগাতার উন্নয়ন হচ্ছে দীঘার। বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। সবাই খুশি। অন্ধকার শুধু এক জায়গায়। ভালো নেই সমুদ্র সৈকতের চিত্রকররা।
আগের চেয়ে দীঘা এখন অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, সমুদ্রের পাড়। পর্যটকদের বিনোদনের সবরকম ব্যবস্থাও রয়েছে। সমুদ্র পাড়ে কিংবা বিশ্ববাংলার লোগোর সামনে সেলফি-তোলার জন্য তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন নতুন স্পট। সমুদ্র থেকে সরে এসে সেখানে ভীড় জমাচ্ছেন পর্যটকরা।
আরও পড়ুন: বড়দিনে নয়া সাজে সৈকতসুন্দরী দিঘা
কিন্তু মনমরা দীঘার ছবিওয়ালারা। বাঙালির সযত্নে লালিত দীঘা-স্মৃতিতে তাঁদেরও অবদান কিছু কম নয়। পুরনো অ্যালবামে সদ্য উদিত সূর্যকে তালুবন্দি করে রাখার দুরন্ত কায়দাওয়ালা ছবি মনে করুন। কোনও ফোটোশপ নয়। স্রেফ হাতের কাজ। সেই ‘শিল্পী’রা আজ বিপন্ন। বদলে যাচ্ছে তাঁদের উপার্জনের পথ। এখন স্নানের সময়টাই ভরসা। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ট্যুরিস্টদের সমুদ্রে দাপাদাপির মুহূর্তকে লেন্সবন্দি করার আর্জি নিয়ে হাজির হয়ে যান সমুদ্র পাড়ের ছবিওয়ালারা, "দাদা, একটা স্নানের ছবি তুলবেন না? বৌদি, একটা তুলুন না দাদার পাশে, ভাল করে তুলে দেব।" শুধু দাদা-বৌদিদের কাছে নয়, প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছেও একই আর্জি জানান তাঁরা।
আগে সকাল-সন্ধে তাঁদের দেখা মিলত। এখন মূলত স্নানবেলাতেই আনাগোনা। কতটা বদলেছে দিন? কথা হচ্ছিল পাড়ে দাঁড়ানো এক ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে। জানালেন, "ফোটোগ্রাফির সেই কদর আর নেই। প্রত্যেকেরই শখ ছিল ছবি তোলানোর। কিন্তু এই সেলফির জমানায় সেই দিন আর নেই। যার ফলে আমাদের সংসার চালানো বেশ অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে।" আগে কেমন দিন ছিল? বিষণ্ণ হেসে জানান, "আগে সানরাইজ দেখতে এসে যে পার্টি ছবি তুলত, দেখা যেত তারা যখনই বিচে আসছে, দু’টো-চারটে ছবি তুলছে। সানরাইজ, সানসেট, স্নান - এক একটা পার্টিই দিনে দশ-পনেরোটা ছবি তুলিয়ে ফেলছে। কিন্তু এখন কেবল স্নানের সময়টুকুই ভরসা। আগে যেখানে ৯০/১০০ পিস ছবি উঠত, এখন সেখানে দশটা ছবিই সারাদিনে তুলতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে।"
আরও পড়ুন: কর্পোরেট দুনিয়াকে হাতছানি দিতে প্রস্তুত হচ্ছে দিঘা
ওল্ড দীঘার সৈকতে ছবি তুলে বেড়ানো এক চিত্রকরের কথায়, তিনি চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছেন ট্রেন্ডটা। মোবাইল কীভাবে গ্রাস করছে তাঁর পেশা, সে কথা বলতে গিয়ে জানালেন, "যত দিন যাচ্ছে, তত অবস্থা খারাপ হচ্ছে।" ঘুরেফিরে অন্য ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, তাঁরা প্রত্যেকেই কমবেশি একমত। ব্যবসা ক্রমে খারাপ হচ্ছে।
ঠিক কত টাকা রোজগার হয় একটা ছবি তুলে? জানা গেল, একটা কুড়ি টাকার ছবিতে পাঁচ টাকা পায় ল্যাবরেটরি, পাঁচ টাকা পান স্টুডিওর মালিক। বাকিটা ফোটোগ্রাফারের। এই ল্যাবরেটরিও বেঁধে দেওয়া। ওল্ড দীঘায় একটি, নিউ দীঘায় দু’টি। যাতে ছবির কোয়ালিটি একই থাকে, তাই একই কাগজ ব্যবহার করা দরকার। তাই এভাবে বেঁধে দেওয়া।
ক্যামেরা বদলেছে। আগে ছিল পুরনো লেন্সের ক্যামেরা। ছবি প্রিন্ট করতে খরচ পড়ত বেশি। এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় ভাল ছবি মেলে কম খরচে। কিন্তু খরিদ্দারেই যে ভাঁটা। এখন সবাই ক্যামেরাম্যান। মেগাপিক্সেল খচিত ছবির মোহে আবিষ্ট। নিত্যনতুন অ্যাপ-ট্যাপে সে সব ছবি আরও মোহময়। মোবাইলের লেন্সই সব।
ওল্ড দীঘায় স্নানের সবচেয়ে ভাল জায়গা সি হক ঘোলা। সেখানেই বেশি আসেন ফোটোগ্রাফাররা। তবে অন্য স্পটেও আনাগোনা থাকে। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা। ছবি তুলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙে। দিন যায়। ছবিওয়ালার চোখ সরে না লেন্স থেকে। যদি সুদিনের দেখা মেলে।
বর্তমান সরকারের আমলে চিত্রকরদের জন্য গঠিত হয়েছে ইউনিয়ন। বেশ কয়েকটি শাখায় তাঁদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে এলাকায় এলাকায়। তবে যিনি যত বেশি ছবি তুলতে পারবেন, তাঁর তত বেশি কমিশন। অর্থ উপার্জনের নেশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে জলের মধ্যে বা সমুদ্রের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ফটোগ্রাফাররা।
চিত্রকররা তাঁদের দুরবস্থার কথা দীঘা-শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদের কাছে জানিয়েছেন। তাঁদের আবেদন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিয়েছেন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা স্থানীয় সাংসদ শিশির অধিকারী।