বছর কয়েক আগেও তাঁর পুজো কাটত আর চার-পাঁচটা বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির সাধারণ ছেলেদের মতো। বন্ধুবান্ধব, পরিজন, এঁদের সঙ্গেই মশগুল হয়ে শারদ আনন্দে মাততেন তিনি। চোখে ছিল তাঁর হাজার স্বপ্ন। তাঁর বাবা বলতেন, "এমন কিছু করো, যেটা আর কেউ করেনি।" বাবার সেই কথাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিদ্ধার সেই তরুণ, সমর্পণ মাইতি। সেই বাঙালি তরুণ তুর্কির এবারের পুজো ‘স্পেশাল’।
গ্রামের ছেলে সমর্পণের নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে কখনই ছুৎমার্গ ছিল না। বরং তা এ গোঁড়া সমাজকে বারংবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সেই লড়াইয়ে অনেকটাই জিতে গেছেন ওই বাঙালি তরুণ। ছেলে সমকামী, একথা জানার পর সমর্পণের মায়ের মুখের ভাষা পাল্টে গিয়েছিল। কিন্তু না, ছেলেকে বকেননি বা ছেলের প্রতি কড়া মনোভাব পোষণ করেননি। বরং খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে বুঝিয়ে আদরের ছেলেকে সমাদরে গ্রহণ করেছেন। আর এখানেই সবথেকে বড় জয় হয়েছে তাঁর। সেই জয়ের আত্মবিশ্বাসেই বোধহয় অভাবনীয় ভাবে মিঃ গে ইন্ডিয়ার খেতাব ও পরে মিঃ গে ওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় রানার্স আপের সম্মান ছিনিয়ে নজির গড়েছেন বাংলার সমর্পণ। সেই জয়ের পর তাঁর এবারের পুজো অন্যরকম।
পুজো নিয়ে বলতে গিয়েই প্রথমে পুজোর প্রেম নিয়ে মুখ খুললেন সমর্পণ। সদ্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। এ প্রসঙ্গেই মিঃ গে ইন্ডিয়া বললেন, "পুজোর মধ্যে প্রেমের ব্যাপারটা দারুণ। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষরাও সেই প্রেমের জোয়ারে গা ভাসাতে চান। তবে সমাজের চোখরাঙানির ভয়ে সেই স্বাধীনতাটুকু থাকে না। এবার আমার মনে হয়, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এঁরা মুক্ত পাখির মতো উড়বেন।"
লাজুক হেসে সমর্পণ এও জানালেন, "পুজোর সময় প্যান্ডেলে গিয়ে আগে কোনও সুন্দর ছেলের দিকে তাকাতাম। যদিও লোকে দেখলে কে কী বলবে, সেটা মাথায় কাজ করত। তবে এবার নির্দ্বিধায় তাকাতে পারব। গতবছর যেমন ম্যাডক্স স্কোয়ারে গিয়েছিলাম। ওখানে আমার কমিউনিটির অনেকেই তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে, এনজয় করছিলাম। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল এ সমাজের জন্য।" পুজোয় কি কখনও প্রেম হয়েছে? হেসে সমর্পণ বললেন, "প্রেম ঠিক না, অনেক ক্রাশ হয়েছে।"
একটা সময় পুজো কাটত গ্রামের বাড়িত। ঠাকুর দেখা বলতে ডেস্টিনেশন ছিল শহরতলী। পরবর্তীকালে বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় প্যান্ডেল হপিং। এ প্রসঙ্গে স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটলেন সমর্পণ। তিনি বললেন, "ছোটবেলায় দুর্গাপুজো মানেই ছিল নতুন জামা। কার ক’টা নতুন জামা হয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলত। তাছাড়া আমার ঝোঁক থাকত বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীর ওপর। খুব পড়তাম তখন শারদসংখ্যা। তারপর, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মজাটাই আলাদা ছিল।" ছোটবেলার পুজো কি মিস করেন সমর্পণ? জবাবে বললেন, "মিস তো করিই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই পাল্টায়। এখনকার পুজোও ভাল লাগে। আজকাল পুজো নিয়ে যে শিল্পকর্ম দেখা যায়, তা খুব ভাল। তবে এখনকার পুজো অনেক বাণিজ্যকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে।"
এবারের পুজোয় কী প্ল্যান? "আমার কাছে আসলে দুর্গাপুজো মানে ঘরে ফেরা। এবারেও বাড়িতে থাকছি। পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটাব। তবে এবারের পুজোয় শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকব। আমায় নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানানো হচ্ছে। তার শুটিং নিয়ে খানিকটা ব্যস্ত থাকব।" যে ছেলে একটা সময় পুজোর নতুন জামা নিয়ে মেতে থাকতেন, সেই ছেলের এবার কোনও পুজো শপিংই হয়নি। তিনি বললেন, "এখন তো সারাবছর ধরেই কিছু না কিছু কিনি, ফলে পুজোর সময় আলাদা করে আর দরকার পড়ে না।"
আরও পড়ুন, এবার রূপান্তরকামীর হাত ধরে চোখ মেলে তাকাবেন মা দুগ্গা
দুর্গাপুজোয় আজও হাতখরচ পান সমর্পণ। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, "ছোটবেলায় মাসি, পিসি, কাকু, কাকিমা, জেঠু, জেঠিমারা হাতখরচ দিত ঠাকুর দেখার জন্য। ওরা আজও আমায় হাতখরচের টাকা দেয়। এ বছরও আমি হাতখরচ পেয়েছি। এটা আমার দারুণ লাগে, খুব মজার।" তবে এবারের পুজোয় তাঁর মায়ের স্কুলের পড়ুয়াদের আর্থিক সাহায্য করেছেন সমর্পণ। একইসঙ্গে কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমেও তাঁর পুজো উপহার পৌঁছে দিয়েছেন এই বঙ্গসন্তান।
পুজোর আচার আচরণ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই তাঁর। কিন্তু সমর্পণ চান, পুজো সবার, ফলে সবাই যেন পুজোর আনন্দে সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। মা দুর্গার কাছে তাঁর বিশেষ ভাবে কোনও প্রার্থনাও নেই, একটাই আবদার, "সবাই যেন ভাল থাকে।"