কয়েকবছর আগেও ওঁরা যখন পুজো মণ্ডপে গিয়ে মা দুর্গার ত্রিনয়নী রূপ দেখতেন, কার্যত ওঁদের ব্রাত্য করে রাখত এ সমাজ। ভিড়ে ঠাসা প্যান্ডেলে ওঁরা গিয়ে দাঁড়ালেই সবার চোখের ভাষা বদলে যেত। কেউবা তখন মা দুর্গাকে ছেড়ে ওঁদের দিকে এমন ভাবে তাকাতেন যেন, ওঁরা সেখানে গিয়ে অপরাধ করে ফেলেছেন। আবার কেউ কেউ তো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, টিটকিরি দিতেও ছাড়তেন না।
সময় পাল্টেছে। সেই ওঁরাই এবার দুর্গাপুজো প্যান্ডেলে কার্যত দাপিয়ে বেড়াবেন। যে সমাজ একসময় ওঁদের দেখে টিটকিরি দিত, সেই সমাজই এবার ওঁদের সসম্মানে পুজো মণ্ডপে ঘোরার সুযোগ করে দিয়েছে। শহরের কোন পুজো সেরা, কোন মণ্ডপ সেরা, কোন প্রতিমা সেরা, এহেন চুলচেরা বিশ্লেষণের দায়িত্ব বর্তেছে এবার ওঁদের ওপর। এই প্রথমবার শহরের দুর্গাপুজোর শারদ সম্মানের বিচারক হিসেবে থাকছেন রূপান্তরকামীরা।
আরও পড়ুন: "এই রায় গোটা দেশের জয়", বললেন মেঘ সায়ন্তন ঘোষ
মৃগনয়নী উমা শারদ সম্মান ২০১৮-এর হাত ধরে এবার মণ্ডপে মণ্ডপে বিচারক হিসেবে ঘুরবেন রূপান্তরকামী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ এবং জয়িতা মণ্ডল। এহেন সম্মান পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন দেশের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, "ছোটবেলায় ষষ্ঠী-সপ্তমীতে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে আসতাম বাবা-মা’র সঙ্গে। তারপর যখন রূপান্তরকামী হিসেবে প্যান্ডেলে যেতাম সেখানে সবাই অন্যরকম চোখে তাকাতেন, কেউ বা টিটকিরি দিতেন, হাসি-ঠাট্টা করতেন। তাই গত কয়েক বছরে পুজোর সময় কলকাতার বাইরে চলে যেতাম।" খানিকটা থেমে মেঘ ফের বললেন, "আজ একথা বলতে গিয়ে চোখে জল আসছে, যে আমি বিচারক হিসেবে মণ্ডপে মণ্ডপে যাব। কখনও ভাবিনি এই সম্মান পাব। বেশ কয়েকবছর বাদে আবার ঠাকুর দেখব কলকাতায়।"
শারদ সম্মানের বিচারক হিসেবে এবার থাকছেন আরেক রূপান্তরকামী, জয়িতা মণ্ডল। ইসলামপুর লোক আদালতের বিচারক জয়িতা এ প্রসঙ্গে বললেন, "এই প্রথমবার সসম্মানে পুজোয় ঘুরতে পারব। এটা অনেকটাই বড় সম্মান। ছোটবেলায় কত বিদ্রূপ শুনেছি। রূপান্তরকামী হিসেবে যখন গিয়েছিলাম, তখন শুধুই টিটকিরি পেয়েছি। উমা মানে একজন নারী, উমা দুর্গারই আরেক নাম, এবং প্রত্যেক নারীর মধ্যেই উমা বর্তমান। সুতরাং সমাজ হয়তো আর ভাবছে না, যে এঁরা রূপান্তরিত নারী। আমাদের নারী হিসেবেই যে সম্মান দেওয়া হচ্ছে, সেটা একটা বড় ব্যাপার।"
আরও পড়ুন, পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর থেকে সফল আইনজীবী, বিজয়ী রূপান্তরকামী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ
মৃগনয়নী উমা সম্মানের অন্যতম মূল উদ্যোক্তা রাজর্ষি দাস এ প্রসঙ্গে বললেন, "এবার তিন বছরে পড়ল আমাদের শারদ সম্মান। এবারের থিম সমাজের উমাদের নিয়ে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী মহিলাদের নিয়েই আমরা বিচারকমণ্ডলী সাজিয়েছি। মোট ২৮ জন মহিলা বিচারক থাকছেন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। যাঁদের মধ্যে রূপান্তরকামী হিসেবে থাকছেন মেঘ সায়ন্তন ও জয়িতা। এছাড়াও দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিও আমাদের সঙ্গে থাকছে। অর্থাৎ যৌনকর্মীরাও বিচারকের ভূমিকায় থাকছেন।" বিচারকমণ্ডলীতে বিভিন্ন ধরনের উমাদের থাকার কারণ হিসেবে রাজর্ষি বললেন, "আমরা কেউ পিছিয়ে নেই, সবাইকেই সামনের দিকে এগোতে হবে। আমরা সবাই, সমাজকে এই বার্তা দিতেই এমন ভাবনা।"
অন্যদিকে, এবছরের পুজোটা আরও একটা কারণে বিশেষ মেঘ সায়ন্তনের কাছে। রূপান্তরকামী হিসেবে এই প্রথমবার এ শহরের পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছেন তিনি। এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়। যে দুই পুজো কমিটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছে মেঘকে, তার মধ্যে রয়েছে তাঁর পাড়ার পুজো সোনারপুর রিক্রিয়েশন ক্লাব। এ প্রসঙ্গে মেঘ বললেন, "এবারের পুজোটা আমার জন্য উপরি পাওনা। আমার পাড়ার যে ক্লাবে একটা সময় যেতে অস্বস্তি হত, সেখানে এবার আমায় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছে।"
শারদ সম্মানের বিচারক হিসেবে তাঁদের গ্রহণ করার ব্যাপারে মেঘ বললেন, "এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। এভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে আমাদের।" মেঘের সুরেই সুর মিলিয়ে জয়িতা বললেন, "আশা করছি আগামী দু-চার বছরে সমাজে সেই বিভাজনটা থাকবে না।"