লাঠালাঠি বাঙাল-ঘটি হোক, কিংবা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের রেষারেষি, চিংড়ি-ইলিশের বাহারের এই লড়াই কিন্তু চিরন্তন। খাবার হোক কিংবা নিয়ম রীতি, হরেকরকম নতুনত্বে ও দুর্গাপুজো কিন্তু সবার কাছেই আনন্দের রেশ! পেটপুজো থেকে সাজগোজ কারও কোনও কিছুতেই এক্কেবারে খামতি নেই।
কথায় আছে, তখন এপার বাংলা আর ওপার বাংলায় পুজোর নিয়মে কোনও পার্থক্য না থাকলেও পেটপুজোয় কিন্তু কিছু না কিছু তফাৎ ছিলই। তার মতভেদ এবং চর্চা কিন্তু ভিন্ন। সেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ম কিন্তু এখনও অবধি চলে আসছে। ভিন্ন জায়গায় তার নানা ধরন। সেটি ঠিক কীরকম?
পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ অধিবাসীদের মধ্যে যে বিষয়টি ভীষণ নজরকাড়া সেটি হল অষ্টমী মানেই ফুলকো লুচির সঙ্গে হরেক পদের আয়োজন। ছোলার ডাল থেকে মিষ্টি আলুর দম, এবং মুগ হালুয়া থেকে চিনির পায়েস। প্রথা মেনে অষ্টমী মানেই নিরামিষ। বলা যেতে পারে অন্ন সেদিন খাওয়াই হয় না। আর নবমী মানেই পেট পুরে মাংস ভাতের এলাহী আয়োজন। সঙ্গে অন্যপদ থাকে বটে তবে এটিই মূল আকর্ষণ।
যেটুকু শোনা যায়, দশমী মানেই ছিলেকাটা নিমকি আর নাড়ুর বোঝাই ছিল বিজয়ার আসল টান। বাড়ি বাড়ি ঘুরলে গোটা কয়েক নাড়ু না নিয়ে কেউই ফিরতেন না। তবে খাবারের আস্বাদনে বেশ ভাগ আছে বইকি! একটু নজর দিলেই দেখা যায় বেশিরভাগ ব্রাহ্মণ বাড়িতে পুজোর তিনটি দিন সকলেই নিরামিষ খান অর্থাৎ ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী তিনদিন বাইরে যেমনই হোক না কেন বাড়ির ভেতর কিন্তু একদম আমিষের ক্ষেত্রে ফুলস্টপ। পার্বণের অন্যান্য দিন গুলিতেও নিরামিষ পোলাও কিংবা খিচুড়ির টান ছিল বেশি।
এবার আসা যাক ওপার বাংলার গল্পে। এইখানে কিন্তু বেজায় জটিল ব্যাপার স্যাপার। এক একটি জেলায় এক এক ধরনের খাবার আর নানান নিয়মেও ছড়াছড়ি। একটু ঘুরে আসা যাক!
এই যেমন কুমিল্লার গল্প বলতে গেলেই বেশিরভাগ বাড়িতেই পুজো মানেই নিরামিষ আয়োজন। পোলাও, খিচুড়ি, লাবড়া থেকে আরও কত কি! অষ্টমীতে অন্ন খাওয়ার কোনও বারণ একেবারেই নেই। আর নবমী মানেই কব্জি ডুবিয়ে মাংস সঙ্গে যেকোনও একটি মাছের পদ। দশমীতে মন্ডা পিঠে আর রসমালাই ছিল বিশেষ ব্যাপার।
তবে ময়মনসিংহে ঘুরলে, পুজো মানেই তিনদিনের নিরামিষ খাবার। নবমীতে তখন নাকি বলির মাংস প্রসাদ হিসেবেই সবাই খেত। মিষ্টিতে চিনির পায়েস আর মুড়ির মোয়া একেবারেই ম্যান্ডেটরি! তবে সুন্দর একটি বিষয় ছিল বেশ, বিজয়ায় বাড়ি এলেই তাকে নাকি পান সেজে দেওয়া হত এটি নাকি সৌজন্যের প্রতীক।
খুলনা জেলার অষ্টমীতে ছোট্ট লুচি, কুচি নারকেলের ছোলার ডাল, সঙ্গে গুড়ের আর তিলের নাড়ু। শুনলেই কেমন মন ভাল হয়ে যায়। সিলেটের আবার বেশ রসালো একটি নিয়ম। নবমীতে চুইঝালের মাংস রান্নাই নাকি তাদের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল।
একটু অন্যরকম বরিশালের খাওয়াদাওয়া। একেবারেই নিরামিষ খাবারের নাকি কোনও চল ছিল না। অষ্টমীতে মাছের মুড়ো দিয়ে যেকোনও স্পেশাল আইটেম রাখতেই হবে মেনুতে। নবমী মানেই খাসির মাংসের আয়োজন। আর শখের ওপর ভিত্তি করেই ক্ষীরের মোয়া আর মুড়ির মোয়া তৈরি হত।
এক্কেবারে আলাদা কিন্তু ঢাকা শহরের খাওয়াদাওয়া। হাজার নিয়ম রীতি মেনেই আজও একইরকম ভাবে আয়োজন করা হয়। অষ্টমী অবধি নিরামিষ অবধারিত। দশমীতে মাছের মাথার তরকারি, রুই কিংবা কাতলা মাছ ভাজা, লাল শাক ভাজা এগুলো কিন্তু হতেই হবে। আরেকটি নিয়মের মধ্যে পড়ে যাত্রা থালা! তবে এর সঙ্গে খাবারের যোগ কী? আছে! ঠাকুরের থালাতেই কাঁচা হলুদ-সিঁদুর-তেল-প্রদীপ জ্বালিয়ে তাতে রাখা হয় দুটি পুঁটি মাছ, এমনকি সারা বছরে অঙ্গে পড়ে থাকা সোনার গয়না খুলে রাখা হয় তাতে। মা দুর্গার বিদায়ক্ষণে যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই প্রদীপ নিভছে থালায় হাত দেওয়া চলে না। পরেই সেই দুটি পুঁটি মাছ কেবলমাত্র হলুদ এবং নুন দিয়ে কাঁচা অবস্থায় রান্না করার পরেই পরিবারের সকলে অল্প করেই খান সেটি।
ওই যে বলে পুজোয় এক একজনের হরেক রকম খাবার দাবার! কিন্তু স্বাদ মানুষকে একত্র করে রেখেছে। পুজোর ভোগ হোক কিংবা বিজয়ার মিষ্টি, দুই পক্ষের নিত্যনতুন কিছু না কিছু বাংলার সংস্কৃতির এক অটুট সম্পর্ক। নিয়ম বদলেছে অনেক, আবার অনেকেই পুরনো রীতি আজও মেনে আসছেন। তবে পুজো মানেই যে সবার আগে পেটপুজো এটি কিন্তু শত সহস্র বারের জন্য সত্যি, এই পাঁচদিন খাওয়া দাওয়া হইচই আর প্রাণখোলা আনন্দে শুধুই হুল্লোড়ে মাতামাতি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন