আমরা বেড়াতে ভালবাসি, বাঙালির ডিএনএ-তে রয়েছে বেড়ানো। অধিকাংশই চতুর্থী নাগাদ বেরিয়ে পড়ি, ফিরি দশমীর পর। কেউ কেউ বিদেশের দিকেও পাড়ি জমান, যার অর্থ হলো দু'সপ্তাহ থেকে একমাসের সফর। এঁদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বা ব্রিটেন, বা অস্ট্রেলিয়ায় কী দেখবেন বা করবেন তাঁরা, এক পাতা লম্বা একটা লিস্ট পাবেন। নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, বা লন্ডনের ঝকঝকে গ্ল্যামার, বা মেলবোর্ন অথবা সিডনির আশেপাশে বেড়াতে যাওয়া, এসবের আকর্ষণ চিরস্থায়ী। কলকাতায় বেড়াতে আসা কোনও আন্তর্জাতিক পর্যটকেরও ওই একই তালিকা থাকবে।
কিন্তু একটা শহরে দীর্ঘদিন বসবাস করলে তার আকর্ষণের ধরন বদলে যায়। যেমন ধরুন, শনিবার বা রবিবারের সকালের ভিক্টোরিয়া মার্কেট নিয়ে মাতামাতি করবেন মেলবোর্নের অধিকাংশ বাসিন্দাই। ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কুইন ভিক্টোরিয়া মার্কেটে পাওয়া যায় নানা প্রকার সবজি, মাছ, মাংস, সামুদ্রিক প্রাণী, এবং আরও অনেক কিছু। চারপাশে অঢেল ক্যাফে এবং 'পাতিসেরি' (patisserie), ফলে রবিবার সকালে বাজারে যাওয়া মানে ভরপেট 'সানডে ব্রাঞ্চ' অবধারিত। ঔপনিবেশিক আমলের এই মার্কেটটি দেখলেই আমার মনে পড়ে আমাদের নিজেদের নিউ মার্কেটের কথা। মূল কাঠামো এবং তার ভেতরে দোকানগুলির অবস্থান প্রায় এক ধরনের। একমাত্র তফাৎ হলো, মেলবোর্নের বাজারে গ্রাহক টানতে তারস্বরে চিৎকার করেন দোকানদাররা, যা নিউ মার্কেটে হয় না, ভাগ্যিস!
ভিক্টোরিয়া মার্কেটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে ব্রিটেনে অক্সফোর্ডের কভার্ড মার্কেট এবং অস্ট্রেলিয়াতেই অ্যাডিলেইডের গৌগার স্ট্রিটের সেন্ট্রাল মার্কেট। অক্সফোর্ড শহরটা খুব সুন্দর। তারই কর্নমার্কেট স্ট্রিটের লাগোয়া ছোট্ট একটি গলিতে সেই ১৭৭৪ থেকে বিরাজ করছে কভার্ড মার্কেট, যেখানে পাওয়া যায় মাংস, মাছ, সি ফুড, এবং নানা ধরনের চীজ। আড়াইশো বছরের ঐতিহ্যবাহী এই বাজার ঘিরে গড়ে উঠেছে একাধিক কেকের দোকান এবং চকোলেট বুটিক, যেগুলিও যথেষ্ট পরিমাণে পর্যটক টানে।
ওপরের যে দুটি বাজারের কথা বললাম, দুটিই নিজেদের প্রচার করে 'হেরিটেজ' আকর্ষণ হিসেবে, কিন্তু এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের উত্তর কলকাতার মাণিকতলা বাজারের ধারেকাছেও আসে না কোনওটাই। একান্ত নিজস্ব প্রাণশক্তি এবং গতি রয়েছে মাণিকতলা বাজারের, একাধারে মোহময় এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টিকারী। মেলবোর্ন, অ্যাডিলেইড, বা অক্সফোর্ডে যা হয় না, তা এখানে হয় - ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকেই সারাদিনের পণ্য নিয়ে ঢুকতে শুরু করেন বিক্রেতারা। সকাল ছটার মধ্যে বাইরে সাজানো হয়ে যায় শাকসবজি, তা সে ছোটখাটো সবজিওয়ালা হোন বা বড়সড় কারবারি। খদ্দেররাও তেমনি - কাকভোরে এসে হাজির। সাতটা নাগাদ তো রীতিমত দ্রুতছন্দে শুরু হয়ে গেছে কেনাবেচা, গোটা উত্তর এবং মধ্য কলকাতা থেকে আসা গ্রাহকদের সৌজন্যে, রোজকার মাছ, মাংস, সবজির সন্ধানে।
পশ্চিমের দেশে বাজার করার মধ্যে কোনও আন্তরিকতার ছোঁয়া নেই, কিন্তু উত্তর কলকাতার 'বাজার সংস্কৃতির' ভিতটাই হলো দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা মজবুত পারস্পরিক সম্পর্ক। এই সম্পর্কের মূলে থাকে বিশ্বাস, এবং প্রায়শই তা উঠে যায় স্বাভাবিক ক্রেতা-বিক্রেতার সমীকরণের উর্ধে। এমন দিনও গেছে যখন ৫০০ টাকারও বেশি বাকি করে আমার নিয়মিত মাছওয়ালার কাছ থেকে মাছ নিয়েছি আমি, অর্থাৎ ধার করে। প্রতিবারই মাছ কিনতে গেলে বেশ কয়েক কাপ চা হয়, সঙ্গে চলে জিনিসপত্রের বাড়তে থাকা দাম, স্থানীয় রাজনীতি, বা শিরোনামে থাকা অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা। এ একেবারে নির্ভেজাল উত্তর কলকাতার বাজারের আড্ডা, যা পরোয়া করে না শ্রেণী বা অন্যান্য সামাজিক বিভাজনের।
মাণিকতলা বাজারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর গন্ধ। অনেকেই এই মাছের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে সকালবেলার ঘামে ভেজা শরীরের গন্ধের সংমিশ্রণ সহ্য করতে পারেন না, তাই এড়িয়ে চলেন। কিন্তু আমার কাছে এটা যেন আমার বাড়ির গন্ধ। রোজ মাণিকতলা বাজারে যাওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমার নিখাদ উত্তর কলকাতা আঙ্গিকের লালন-পালন, যা আমার কাছে চিরকাল গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে।
হ্যাঁ, উত্তর কলকাতার বাজারকে হয়তো ঠিক 'ট্যুরিস্ট হটস্পট' বলা চলে না, কিন্তু তার অভিনব, প্রাণবন্ত ছন্দের আলাদা একটা মূল্য আছে বৈকি। এই বাজারে শুধু নতুন বন্ধুত্ব বা পরিচয় তৈরি হয় না, পুরুষানুক্রমে বহমান সম্পর্কের ধারাও বজায় থাকে, মূল সম্পর্ক যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁরা চলে যাওয়ার বহুবছর পরেও। কলকাতার চিরকালীন আকর্ষণ হয়ে থেকে যাবে এই ধরনের সম্পর্ক।
উত্তর কলকাতায় বেড়ে ওঠার সুবাদে আমি পৃথিবীর যেখানে যখন যাই, যতরকম মাছের বাজার হতে পারে, সব ঘুরে দেখার চেষ্টা করি। এতদিনে উত্তর কলকাতার মাছের বাজারের কাছাকাছি আসতে পারে এমন আর একটিই পেয়েছি, তা হলো বার্বেডসের অইস্টিন বাজার। শুক্রবার এবং শনিবার সন্ধ্যায় শয়ে শয়ে স্থানীয় এবং পর্যটক ভিড় জমান অইস্টিনে, স্থানীয় ভাজা মাছ এবং গ্রিল করা সুস্বাদু সব খাবারের খোঁজে। ব্যাকগ্রাউন্ডে জোরে মিউজিক বাজতে থাকে। পুজোর সময় এই ব্যবস্থা মাণিকতলাও করলে পারে কিন্তু। এমনিতেই বাজার সমিতি আয়োজিত দুর্গাপূজা আছেই, সেটিকেই উৎস করে পাশের গলিতে আরেকটু জায়গা নিয়ে বেশ একটা সান্ধ্য উৎসবের কথা ভাবাই যায়। উত্তর কলকাতার খাবারের যত বিশেষত্ব আছে, সবই পরিবেশন করা যায় এখানে। এই অস্থায়ী কার্নিভালের দৌলতে নতুন প্রাণ ফিরে পেতেই পারে মাণিকতলা বাজার, যা কিনা স্পেন্সারস-এর মতো রিটেল চেইনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে অত্যন্ত জরুরি।
আমার কাছে মাণিকতলা বরাবরই বিশেষ হয়ে থাকবে। আমার বাবা এখানেই আমাকে নিয়ে আসতেন মাছ কেনা শেখাতে। বাড়িতে বারবার শুনতাম, "বাঙালির ছেলে বাজার করতে জানবে না, তাহলে জানবে কী"। আজ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ভালো বাজার করতে জানি, এই ব্যাপারটা আমার 'মেল ইগো'কে রীতিমত গর্বিত করে! আর হ্যাঁ, যেদিন বিশেষ কোনও বাজার করি, সেই দিনটাই অন্যরকম হয়ে যায়। এমন বহুবার হয়েছে যে বাজারে গিয়েছি একেবারে নির্দিষ্ট শপিং লিস্ট নিয়ে, এবং ফিরে এসেছি একগাদা আপাত অদরকারী জিনিস নিয়ে। কেউ "ভালো ইলিশ আছে নিয়ে যান" বললে না করা যায় না। একই কথা প্রযোজ্য চিংড়িমাছের ক্ষেত্রেও। পুজোর সকালবেলা ভালো বাজার, তারপর বাড়িতে জমিয়ে খাওয়া, ওতেই আমার স্বর্গলাভ। এই একটিই যোগসূত্র অবশিষ্ট রয়েছে উনিশ শতকের বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের সঙ্গে, আমি মনেপ্রাণে যার অংশ বলে মনে করি নিজেকে। এই যোগসূত্র আমি কোনোকিছুর টানেই ছাড়তে পারব না, মরে গেলেও না।