সামনে সাদা-গেরুয়া-বসনা। জটাধারিণী। ব্রহ্মাণ্ড ছানবিন করে বেড়ানো বাউল। আর তাঁকেই কিনা একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছি - "শুনেছি খুব রেডিও-ভক্ত ছিলেন! তো, বিবিধ ভারতী, অনুরোধের আসর শুনতেন? আশা, লতা, মুকেশ, রফি, কিশোর?" "সিনেমা দেখেন নাকি প্রচণ্ড। আপনার কিশোরীবেলায় ‘শোলে’ তো মেগা হিট! দেখেছেন?" "চট্টগ্রামের বাঙালি। কোচবিহারে বড় হলেন। জীবনসঙ্গী কেরলের। সব মেছো এলাকা। বাউল হলেও আপনিও নির্ঘাৎ মৎস্য-প্রিয়?"
তিনি পার্বতী দাস বাউল। সময়টা ২০১৭। নভেম্বর, কী ডিসেম্বর। আজ তার প্রায় বছর দুই পার। ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের দেড় দিনও তখন কাটেনি। তার মধ্যেই অমন বাচাল-সাংবাদিকী ঢং, ইদানীং কেমন সিঁটিয়ে দেয়। তার চেয়েও নাড়িয়ে যায় অত চড়া 'বাজারি' প্রশ্নের মুখে ওঁর সেদিনের দেহভঙ্গী, সওয়াল-জবাবের তাল-লয়-ফাঁক খুঁজে নেওয়ার অনায়াস তরিকা।
এ ঘটনার আবার একটা 'মুখড়া' আছে, যার আলাপটুকু শুনলে ওই বাচালপনার ধরনে পাঠক যে আরওই অবাক হবেন, তাতেও ন্যানো-ইঞ্চি বিস্ময় নেই। আড়াই বছর ধরে ওঁর 'এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ'-এর তাল ঠুকছি তখন। সব ক'টা সোর্স ডাহা ফেল। তার ওপর পার্বতী 'গেছো দাদা'র চেয়েও বেশি বেশি করে হাওয়ায় মেলানো প্রায় অদৃশ্যজীবী। আজ লাটভিয়া, তো পরশু লাক্ষাদ্বীপ, তরশু লাস ভেগাস। সঙ্গে এও শুনতাম, ভীষণ মুডি, চুজি। সাংবাদিক শুনলেই 'অ্যাবাউট টার্ন'।
তো, সেবার কলকাতায় ওঁর শো। পরদিনই ছুটবেন শান্তিনিকেতন। কামারডাঙা। ওখানে ওঁর নতুন আশ্রম হচ্ছে। 'সনাতন সিদ্ধাশ্রম'। তারই দেখভাল করতে। সফরসঙ্গী হওয়ার ব্লু-প্রিন্টটা বানিয়ে দিল কলকাতায় সেই শো-এর আয়োজক আমারই এক বন্ধুজন, পার্বতী-ঘনিষ্ঠ নট-নির্দেশক-অভিনেতা মণীশ মিত্র।
পরদিন ভোর। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। কোচ সি-ওয়ান। কামরায় ঢোকামাত্র দেখি জনা দশ-বারো নানা ভাষাভাষীর মধ্যমণি হয়ে বসা তাঁদের পার্বতী-মা। একটু পরেই এই দলের অন্যদের সঙ্গে আলাপ হবে। অর্পিতা, আরতি, সাকুরা, স্যামুয়েল, গ্রেস, রাম। একজনও বাঙালি নন। কেউ জাপানী, কেউ ফ্রান্সের, কেউ বেঙ্গালুরু-বাসী, তো কেউ রায়পুরের। সবাই হাত দশ-বারো দূরত্বে। নিজেকে কেমন ফেলুদা-ফেলুদা টাইপ লাগছিল! ট্রেনটা রাজস্থানগামী নয়। ওদিকে কোনও মুকুল, ডঃ হাজরা বা মন্দার বোস নেই, তবু একটা চাপা রহস্য, আড়াল খুঁজে নজর রাখা, ট্রেন-কামরায় তাল বুঝে আলাপ করা, তারপর বহু দিনের না-পারার রহস্য ভেদ করতে চাওয়া, সবটা মিলে...।
ও দিকে নরম হাসি, হালকা গল্পের ইঙ্গিত পেতেই উঠে গিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে ভিজিটিং কার্ডটা দিয়ে আবদার করলাম, "যদি অনুমতি মেলে, আপনার শান্তিনিকেতনের প্রজেক্টটা দেখতে চাই।" ভাবলেশহীন মুখ। হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। ভ্যাবলা বনে ফিরে সিটে বসে 'হোম ওয়ার্ক'-এ মন দিলাম। সম্বল বলতে টুকটাক নোট্স আর পার্বতীরই লেখা 'সং অফ দ্য গ্রেট সোল' নামের একটা ফালি বই। শিকে ছিঁড়লে এই হোমওয়ার্কটুকুই যা সম্বল।
ততক্ষণে ফর্দ করে ফেলেছি। আদি নাম মৌসুমী। মৌসুমী পাড়িয়াল। পড়াশুনোর শুরু কোচবিহার। বাবা বীরেন্দ্রনাথ পাড়িয়াল। রেল-চাকুরে ছিলেন। এখন বারাসাতে। বয়স যখন পনেরো, তখনই পাকেচক্রে মৌসুমীর প্রেম বাউলে। কোচবিহারেরই ইন্দিরা দেবী-তে প্রাইমারি শেষে, সুনীতি অ্যাকাডেমিতে ইস্কুলবেলা কাটিয়ে বিশ্বভারতী। ট্রেনে চেপে দাদার সঙ্গে যাচ্ছিলেন শান্তিনিকেতন। তখনই এক অন্ধ বাউলের গান ওঁকে পাকড়ে ফেলে। এরপরই গুরুমা পান ফুলমালা দাসীকে। একতারা শেখেন। সেখান থেকে বাঁকুড়ায় সনাতন দাস বাউল। তারপর শশাঙ্ক গোঁসাই।
ট্রেন সফরে আর কথা হল না। স্টেশনে নেমে দেখি, ডেকে নিলেন নিজের টোটোয়। সেই যে চাকা ঘুরল, সে চাকার 'গড়ান' আজও চলেছে তরতরিয়ে। শান্তিনিকেতনের ওই দিন দুই-এর বাস থেকে আজ এই দেড়-দুই বছর। কত ভাবে দেখলাম ওঁকে! মঞ্চে, মঞ্চের বাইরে।
নিমীলিত চোখের কিন্নরী যখন একতারা আর ডুগিতে হাত রেখে গলায় ধরেন, 'গোরা যদি হইত আমার কুমকুম চন্দন, আমি অঙ্গেতে মাখি, আমি গৌ-উ-র-র বলে ডাকি', তখন ঘোর আস্তিকেরও আধিদৈবিক লাগে। নীল চাঁদোয়ায় নীচে দোল খাওয়া রোদের খেলার আলোছায়ার মায়ায় যখন চোখ মেলেন তিনি, কী চকর পাখির ডাকে অস্ফুটে বলে ওঠেন, "কত ডাক জানে যে পাখিটা!", আলের ধারে শ্বেত আকন্দ খুঁজে পেয়ে বিড়বিড়িয়ে ওঠেন, "ব্যথা কমাতে খুব কাজে লাগে গাছটা", তখন যে দরদিয়া সুর ভাসে ওঁর ঠোঁটে, চোখের তারায়, তার কোনও স্বরলিপি হয় না। আবার কোনও সময় সেই একই মানবী রসিক চঞ্চলা দুষ্টু কিশোরী যেন। যে নির্দ্ধিধায় উছলে ওঠে বলে, "সব কৃষ্ণভক্তই একটু দুষ্টু-দুষ্টু হয়!"
আবার সন্তানহারা দম্পতির আবাসে বসে প্রবল জ্বরে পুড়তে পুড়তে ওঁকে যখন গাইতে দেখেছি, তখন ওঁর রূপ যেন আদিগন্ত বিস্তৃত কোল-পেতে রাখা কোনও এক বিশ্বমায়ের। আর আন্তর্জাতিক রেসিডেনশিয়াল ওয়ার্কশপ, কী সেমিনারে? সে এক অন্য পার্বতী দাস বাউল। স্বভাব-শীতল শান্তস্নিগ্ধ ধারাটি বজায় রেখে দশ-দিক হাতের তালুর মধ্যে রাখা এক-আকাশ ছড়ানো হৃদ-ছোঁয়া নেত্রী।
ফিরে যাই সেই সেদিনের আড্ডায়। কামারডাঙা। এবড়োখেবড়ো মাটির পুকুরধার। ঢালু ঘাস জমিতে বসেছি তিনজনে। আমি, পার্বতী আর ওঁর আপ্ত-সহায়ক রামচন্দ্র রাও রোড্ডাম, ওরফে রাম। রেকর্ডার অন। আড়াই বছরের প্রতীক্ষার উদ্যাপন। কানে বাজছে ওঁরই গান, 'কিছুদিন মনে মনে...'।
"বিশ্বভারতীতে পড়তে গিয়ে বাউল হলেন! বাবা-মা আপত্তি করেননি?"
"মা নয়। বাবা করেছিলেন।"
"মারধর?"
পাগলা ঝড়ের হাওয়ায় যেন দু’পাশে দুলে উঠল ঝাঁকড়া-চুলো জটা, "বাবা কোনওদিন কাউকে মারেননি। মা’ও না। মা শুধু একবার হোমওয়ার্ক করিনি বলে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবাকে তো কাউকে জোরে বকা দিতেও দেখিনি। একবারই শুধু বকেছিলেন, আমাদের হইচই-এর ঠেলায় ঘুম আসছিল না, তাই। আর বাউল হব শুনে বাবা খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। বাবার কোনও ধারণাই ছিল না বাউল নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে চলে আসা মানুষ। তারপর আসাম। আমাদের বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা আসতেন। সেসব দিকে গেলে হয়তো অসুবিধে হতো না। কিন্তু বাউল? একদম অচেনা, অজানা। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। বাবা আমার কাছে বাউল গান শিখেছেন। একতারাও শিখেছেন। এখন অবশ্য অ্যালঝেইমারস হয়ে গিয়েছে। বয়সটাও তো হল। পঁচাশি পেরিয়েছে।"
"এই পাড়িয়াল পদবিটা ঠিক কোথাকার?"
"চট্টগ্রামের। আসলে গাঙ্গুলী। পাড়িয়ালদের একটা গুষ্টি আছে ওখানে।"
পার্বতীর এক দাদা। তিন বোন। দাদা থাকেন দুবাই। ইঞ্জিনিয়র। দুই দিদি। একজন কোচবিহারে, ইস্কুলে পড়ান। অন্যজন কলকাতায়, ঘরণী।
"যেতে পারেন বাবা-মায়ের কাছে?"
"যাই তো! বেশি থাকতে পারি না।"
"তখন বাউলের আচার-রীতি মানতে অসুবিধে হয় না?"
"না, না। আসলে আমার মা খুব ভক্ত মানুষ। শুধু মায়ের কাছে কেন, কেরলে যখন থাকি, তখনও নিয়ম মানি। কমবেশি সব জায়গাতেই তাই। হয়তো নিজে রান্নাবান্না করে খাওয়াটা হয় না। মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্টেও খেতে হয়। কী করব! অনেকে আবার নিরামিষ রান্না করে আনে।"
"নিরামিষটা নিশ্চই ছোট্ট থেকে নয়!"
"আরে, না না। আমি বাঙালি তো! তবে বাউলরা কিন্তু মাছ খায়। আমি মাছ ছেড়েছি ২০০৭, কী ২০০৮-এ।"
"কোচবিহারের ছোটবেলা, মনে পড়ে?"
"রাজবাড়ির পাশে থাকতাম। যার কাছেই ছিল 'নরনারায়ণ ব্যায়ামাগার'। ওখানে লোকে কুস্তি শিখত। বালির মধ্যে। ইয়া তাগড়াই সব চেহারা। ওরা ছাতু খেত। মুগুর ভাঁজত। ভোরবেলা। আমি দেখতাম। কত বন্ধুর কথা মনে পড়ে। স্কুল..."
"পড়তে ভাল্লাগতো?"
"হ্যাঁ-এ-এ। অঙ্কটা ছাড়া সব (ছলছলিয়ে উঠল হাসি)। কেমিস্ট্রির এক্সপেরিমেন্ট করতে খুব মজা লাগত। একবার ঠিক করলাম, কী করে জল ভেঙে হাইড্রোজেন পাওয়া যায়, দেখব। সে কী কাণ্ড! (কলকল হাসিতে পাহাড়ী ঝোরা যেন লাফিয়ে উঠল লালমাটির দেশে)। তবে ইস্কুলে বেশি করেছি নাচগান। টিচাররা ছাড়ও দিতেন তাতে।"
"বাব্বা! তাই?"
"হ্যাঁ। আসলে কোচবিহার জায়গাটাই এমন যে, ওখানে শিল্প, মানে আর্ট, খুব গুরুত্ব পায়। আমিই দেখুন না, ছোটবেলায় কত্থক শিখেছি, রীতিমতো গুরুর বাড়িতে থেকে। যে জন্য প্রতি মাসে ইস্কুলে আমার দশটা দিন 'অফ' হয়ে যেত। সেটা বাবা-ই পারমিশন করিয়ে নিয়েছিলেন স্কুল থেকে। বাবা টিচারদের বলে রেখেছিলেন, খুব ইম্পরট্যান্ট ক্লাস না থাকলে আমি যেন 'লিবার্টি' পাই। তখন আমি ইস্কুলেরই ওপরতলার কোনও ঘরে গিয়ে নাচ প্র্যাকটিস করতাম।"
"আপনার বাবা তো শুনেছি, গান-পাগল। দুর্ধর্ষ সব লং-প্লেইংয়ের স্টক আপনাদের বাড়িতে। কলকাতা থেকে সব নিয়ে যেতেন আপনার বাবা।"
"হুম। ঠিক। বাবা রেডিওয় গানও শুনতেন খুব।"
"আপনি? বিবিধ ভারতী, অনুরোধের আসর..."
"শুনতাম। তবে হিন্দি গানটা শোনার অনুমতি ছিল না।"
"সে কী! আপনার কৈশোরবেলা মানে তো, রফি-কিশোর-মুকেশ-লতা-আশা..."
"তা’ও না।"
"শচীন কর্তা?"
এবারে ভীষণ উত্তেজিত, "ইয়েস। ইয়েস। বাবা এসডি বর্মণের খুব ভক্ত ছিলেন। ওঁর গানের স্টক খুব বেশি আমাদের বাড়িতে। বাবা অবশ্য ওস্তাদ আমির খানের গানও খুব ভালবাসতেন। আর বেগম আখতার..."
"কোনোদিন আখতারি বাঈয়ের 'পিয়া ভোলো অভিমান' ট্রাই করেছেন?"
চকিতে চাইলেন। মুড়নো ঠোঁটটা দাঁতে কেটে বললেন, "করেছি। হয়নি। আসলে ও গান কারও গলায় হওয়ার নয়।" তারপর নিজের থেকেই বললেন, "ভাওয়াইয়া খুব ভালবাসতাম। কোচবিহারের ঢোলও। ছুটে ছুটে নদীর কাছে চলে যেতাম। মাঝিদের সঙ্গে নৌকায় উঠে পড়তাম। সারিন্দা বাজানো দেখে মন জুড়িয়ে যেত।"
"এ তো খুব সিরিয়াস-সিরিয়াস ব্যাপার-স্যাপার! অন্তত বয়সের তুলনায়। সিনেমা দেখতেন না? তখন তো 'শোলে' সুপারডুপার হিট? অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র-হেমা-আমজাদ..."
"না (শিশুসুলভ চপলতা খেলে গেল মুখের রেখায়), তবে এখন ফ্লাইটে সব সময় খুব সিনেমা দেখি।" (এবার রামের দিকে তাকিয়ে) "তাতে রাম আবার খুব রেগে যায়।" (এতক্ষণ শান্ত হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা রাম এবার কথার পাকে নিজের নামটা শুনে চমকে তাকালেন। তারপর ইংরেজি তর্জমা করে দিতে হাসলেন মৃদু। বলে চললেন পাবর্তী) "এই তো কিছুদিন আগে গুরিন্দার চাড্ডার একটা সিনেমা দেখলাম, 'পার্টিশন'। দুর্ধর্ষ লাগল।"
দিনের আলো মুড়িয়ে এসেছে প্রায়। পুকুর-জলে বিলি কাটছে কালো কালো গাছের ছায়া। পিছনে চাষজমিতে নুয়ে পড়েছে শেষ-বিকেলের আলো। একটু দূরেই খড়ের ছাউনিওয়ালা গোল ঘর। যার চাতালে বসে দুপুরের খাওয়া সেরেছি সবাই। এখান থেকে ওদিকটা এখন ছায়া-ছায়া। কত কত পাখির কূলায় ফেরার ডাক, নাকি আজান দিচ্ছে ওরা! গান ভেসে আসছে হাওয়ার গা বেয়ে বেয়ে, 'ও-ও বন্ধু প্রাণসখা এমন দিনে পাই যেন তব দেখা'।
বললাম, "আপনার গুরুমা ফুলমালা দাসী, সনাতনবাবা, শশাঙ্কদাস বাউল...?"
"সবারই সমাধি হয়েছে।"
"ও! আচ্ছা, এই 'সমাধি' হওয়ার ব্যাপারটা একটু বলবেন?"
আঁধার-আলো পিছলে যাচ্ছে পার্বতীর মুখে। বলতে লাগলেন, "আসলে সত্যিকারের সাধক যাঁরা, তাঁরা পরমাত্মায় লীন হন। তাঁদের দাহ করা হয় না। তাঁদের সাধনার সারবস্তু, যে প্রাণিত শক্তি, সেটা সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সমাধি মাটিতেও হতে পারে। আবার জলেও।"
হঠাৎ কেমন থম মেরে যাওয়া আশপাশে প্রায় নিঝুম স্তব্ধতা। তারই ছেঁড়া-ছেঁড়া ফাঁক গলে শুধু ফিকে হওয়া গানের তান, শোঁ শোঁ হাওয়ার ছড়-টান শব্দ, পুকুরের লাবডুব শুধু।
কী যেন খেয়ালে আবারই বাচালপনায় পেল। বললাম, "একটা সত্যি কথা বলুন তো। এই যে বাউল চর্চা নিয়ে সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন, এত কিছু করছেন, তাতে সাধারণ মানুষের কী এল গেল? তাঁরা গান শুনবেন। বিগলিত হবেন। ব্যস। তারপর?"
আবছায়া সন্ধেয় এক ঈশ্বরী যেন এবার তাঁর ভাব-কাহন, তাঁর মন-গহন, তাঁর আঁকাবাঁকা, এলোমেলো আদি-অনন্তের গুহায় কয়েক পা হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেন আমায়। চরাচরে মায়াস্রোত, আকিঞ্চন সবটা জুড়ে। ডুবসাগরে এক তাপসী উঠে এসেছেন ধরাধামে বুঝি। বলে চললেন তিনি, "এ প্রশ্ন আজকে দাঁড়িয়ে বড় প্রাসঙ্গিক। বাউলের যে জীবনচর্চা, তা যদি কোনও মানুষ নেয়, সত্যি করেই সে উন্নত হয়ে যাবে। চৈতন্যদেবের আটটি শ্লোক আছে, পড়ে দেখবেন। আমি যখন শশাঙ্কবাবার বাড়ি প্রথম যাই, উনি যে খাতাটা খুলে দেন, তাতে চারটি শ্লোক ছিল। জীবনের মূল কথা ওগুলোই। ঘাসের চেয়েও বিনম্র হতে হবে। সহিষ্ণু হতে হবে। সবাইকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শুধু মানুষ নয়, পোকাকেও। মুখে সব সময় হরিনাম রাখতে হবে। ওই নামের মধ্যেই শক্তি আছে। রামকৃষ্ণদেব বলতেন না, যেমন ভাব, তেমনই লাভ, সেটাই। বৈভব, ঐশ্বর্য যা কিছুর জন্য মানুষ ছুটে বেড়ায়, সেগুলো আজ আছে, কাল নেই। এর সঙ্গে একটা কথা, পৃথিবী, জগৎ, প্রকৃতি এই সব কিছুর মধ্যে একটা ক্ল্যারিটি থাকা দরকার। বাউল-জীবনচর্চা এটাই শেখায়।"
থামলেন তিনি। জীবনও থেমে আছে যেন, এক টুকরো জমিতে। ওধারে গোলঘরে গান বদলে গিয়েছে। একতারায় টংটংটংটং-এ কেমন ঝিমুনি-ধরা ভাব। কে বেশ গাইছে, ‘যে জন পদ্ম হেম সরোবরে যায়...'
ছবি: আরতি