কৈলাশ ছেড়ে এবছর বোধহয় একটু বাড়তি আনন্দে আত্মহারা হয়েই বাপের বাড়িতে পা রাখবেন মা দুগ্গা। উমার তো খুশি হওয়ারই কথা। সন্তানের আনন্দে মা খুশি না হয়ে কী আর থাকতে পারেন! মা দুগ্গার ওই সন্তানদের যে এ সমাজ অনেকটাই গ্রহণ করতে পেরেছে। সমকামিতা অপরাধ নয় বলে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। যার জেরে দুগ্গা মায়ের ওই সন্তানদের এবছরের শারদোৎসব খানিকটা স্পেশাল। তবে মা দুগ্গা বোধহয় শুধু তাঁর ওই সন্তানদের জন্যই খুশি নন। এই সমাজের জন্যও খানিকটা খুশি তিনি। কারণ সমাজ পাল্টাচ্ছে, বদলে নিচ্ছে তার গোঁড়ামি। তাইতো এবার পুজোয় রঙের তুলিতে দুর্গা প্রতিমার চোখ ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছেন এক রূপান্তরকামী। কলকাতা ও হাওড়া, দুই শহরের দুটি পুজোর আয়োজকরাই এমন উদ্যোগ নিয়েছেন।
কলকাতার যোধপুর পার্ক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন এবং হাওড়ার মন্দিরতলা টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, এই দুই পুজোতেই মা দুর্গার চক্ষুদান করবেন দেশের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। যাঁর এবারের পুজো "বেস্ট পুজো"। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই হাসিমুখে মেঘ সায়ন্তন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বললেন, "এ বছরের পুজো আমার কাছে খুব চ্যালেঞ্জিং। পুজোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছি, পুজোর বিচারক হয়েছি, মায়ের চোখ আঁকব। এটা আমার কাছে খুব সৌভাগ্যের।" একথা বলার পরেই মেঘ বললেন, "দুর্গা যেমন প্রতিটি নারীর মধ্যে রয়েছেন, তেমনই একজন রূপান্তরকামীর মধ্যেও রয়েছেন। দেবতাদের মিলিত শক্তিতেই দুর্গার আবির্ভাব হয়েছে। মা দুর্গা খুব প্রতীকী।"
মা দুগ্গার চোখ আঁকা বলে কথা, কোনও প্রস্তুতি চলছে কি? জবাবে মেঘ হেসে বললেন, "হ্যাঁ, খানিকটা তো নিচ্ছিই। তবে আমি ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম।" অন্যদিকে, হাওড়ার মন্দিরতলা টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পুজোয় মা দুর্গার চক্ষুদানে মেঘের পাশাপাশি আরও চমক থাকছে। দুর্গাপুজো মানেই বাঙালির কাছে সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ আর সেই কালজয়ী গান। তবে মন্দিরতলার ওই পুজোয় মা দুগ্গার চক্ষুদানের সময় বাজবে লোকগান। না, রেকর্ডে নয়, লাইভ পারফরম্যান্স। লোকশিল্পী তীর্থ বিশ্বাসের গলায় লোকগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মায়ের চোখ আঁকবেন মেঘ সায়ন্তন। এ প্রসঙ্গে তীর্থ জানালেন, "এটা জেলায় সম্ভবত প্রথম যে এমন ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে। দুটি গান গাইছি মূলত। একটা পুরুলিয়ার ঝুমুর গান গাইছি। ‘সুবর্ণখা নদী সোনা পায়ো যদি’ ও ‘তোমায় হৃদমাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না’, এই দুটো গান মিলিয়ে গাইব।"
আরও পড়ুন, একদিন যে প্যান্ডেলে ঢুকতে পারতেন না, আজ সেখানে বিচারক
দুর্গা মায়ের চক্ষুদান বলতেই প্রথমে পুজো উদ্যোক্তাদের মাথায় আসে সেলেবদের নাম। সেখানে একজন রূপান্তরকামী কেন? জবাবে যোধপুর পার্ক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের এবারের পুজোর মূল ভাবনা যাঁর, সেই সৌম্যজ্যোতি সেন বললেন, "সচেতনতাটাই খুব কম। মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, সেগুলো ভাঙা উচিত। সেজন্যই এই পদক্ষেপ। কেউ যে ব্রাত্য নন, সেই বার্তা দিতেই এই উদ্যোগ। দুর্গাপুজো কিন্তু কাউকে ব্রাত্য করে না। আমরাই এই পার্থক্যগুলো করেছি।" একইরকম কথা শোনা গেল মন্দিরতলার ওই পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তিনি বললেন, "এখনও সমাজের অনেকে এঁদেরকে গ্রহণ করতে পারেননি। ওদের সেই সামাজিক স্বীকৃতি দিতে, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই এমনটা ভেবেছি আমরা।"
আগামী ৯ অক্টোবর যোধপুর পার্ক কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজোয় মা দুর্গার চোখ আঁকবেন মেঘ সায়ন্তন ঘোষ। অন্যদিকে, তৃতীয়ার দিন হাওড়ার মন্দিরতলা টর্পেডো ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পুজোর মা দুগ্গার চক্ষুদানের অনুষ্ঠান।