জমিদারি নেই, তবুও বারুইপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোর জৌলুস বিন্দু মাত্র কমেনি। প্রাচীন রীতি মেনে তিনশো বছর এর ঐতিহ্যবাহী পুজো হয় ভেঙে পড়া জমিদারবাড়ির দুর্গামন্দিরে।। আজও মহাদেবকে আগাম খবর দিতে দশমীতে ওড়ানো হয় নীলকণ্ঠ পাখি।
পুরাণ মতে দুর্গার বিসর্জনের পরেই নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাশে গিয়ে মহাদেবকে খবর দেন মা দশভূজা স্বর্গে ফিরছেন। সেই বিশ্বাসে প্রতিবছর বারুইপুর আদি গঙ্গার জলে প্রতিমার বিসর্জনের সময় দুটি করে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ান বারুইপুর রায়চৌধুরী বাড়ির কর্তারা। যদিও নীলকণ্ঠ পাখি ধরা বা কেনা আইনত দণ্ডনীয়।তবুও বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকে চলে আসা ঐতিহ্য ছাড়তে নারাজ রায়চৌধুরীরা। রীতি মেনে বারুইপুরে ফি বছরই রায়চৌধুরীদের প্রতিমা আগে বিসর্জন হয় সবার আগে। তারপর বিসর্জিত হয় অন্যান্য প্রতিমা।
চারপাশে হাজার একটা বারোয়ারী পুজোর ভিড়,চমক থাকলেও আজও অমলিন বারুইপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো। তথাকথিত উৎসবের চাকচিক্য, উজ্জ্বল আলো, আয়োজনের ধুমধাম কোন কিছুই না থাকলেও জমিদার বাড়ির সাবেকী দুর্গাপুজো দেখতে ফি বছর বারুইপুর রাস মাঠের কাছে রায়চৌধুরীদের ঠাকুর দালানে ভিড় জমান আবালবৃদ্ধবনিতা। শুধু বারুইপুর, সোনারপুর নয়, সূদূর জয়নগর, মন্দিরবাজার, কুলতলি থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসেন তিনশো বছরের বেশি প্রাচীন এই এই দুর্গাপুজো দেখতে। একদা পরাধীন ভারতবর্ষের গণ্ডগ্রাম বারুইপুরের জমিদার বাড়িতে শুরু হওয়া এই শারদোৎসব আবহমান কাল ধরে তাঁদের ঐতিহ্য, পরম্পরা বহন করে চলছে।
বারুইপুরের ইতিহাস থেকে জানা গিয়েছে,তৎকালীন নবাবের কাছ থেকে বিশাল এলাকা যৌতুক পান জমিদার রাজবল্লভ চৌধুরী। বারুইপুর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই জমিদারি। পরবর্তীকালে তাঁরা পান রায়চৌধুরী উপাধিও। লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে রাজবাড়ি তৈরি করান রাজা রাজবল্লভ চৌধুরী। তিনশো বছর আগে রাজা রাজবল্লভ রায়চৌধুরী এই দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বর্তমানে এই পুজোর দায়িত্বে থাকা রায়চৌধুরী পরিবারের প্রাক্তন সদস্য অমিয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরী। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোর ইতিহাস বর্ণনা করে অমিয়কৃষ্ণ রায়চৌধুরী জানান, এখনও তিন জন পুরোহিত রীতি মেনে এখানে পুজো করেন। প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে যায় পুজো। সপ্তমী থেকে নবমী নিশি পর্যন্ত প্রতিদিন এখানে বলি হয়। নিয়ম মেনে ছাগ বলি হয় ওই তিনদিন। তবে সবচেয়ে আনন্দ হয় অষ্টমীর দিনে। বিশাল পরিবারের ছিড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিন দেশের সদস্যরাও সেদিন একত্রিত হন। পরিবারের মহিলা সদস্যদের বিশ্বাস, এয়োস্ত্রীরা ওইদিন মিলে মিশে অষ্টমীর ভোগ খেলে পরিবারে সুখ শান্তি আসে। অমিয়বাবুর অভিমান, ‘একদা জমিদার বাড়িতে নৈবেদ্যর ডালা সাজিয়ে যে ভাবে প্রজারা আসতেন এখন আর তার কিছুই পাওয়া যায় না।’ অমিয়বাবু জানালেন, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও একসময় কিছুদিন বারুইপুরের এই জমিদার বাড়িতে কাটিয়েছিলেন। এই বাড়িতে বসেই তিনি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। যে টেবিল, চেয়ারে বসে লিখেছিলেন সেটা এখনও রাখা আছে জমিদার বাড়িতে। জমিদার বাড়ির ঠাকুরদালানেই এক চাল চিত্রে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেন কূল শিল্পী।পুজোর শেষ মুহূর্তের প্রস্ততি এখন তুঙ্গে। দেশ বিদেশে থাকা জমিদার বাড়ির সদস্যরা ইতিমধ্যে রায়চৌধুরী বাড়িতে আসা শুরু করে দিয়েছেন।