Advertisment

Delhi Durga Puja 2018: দিল্লিওয়ালা দুর্গাপুজো- পঞ্চমী

বাঙালির কথা আলাদা। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে বাঙালি টাইপের লোকের দেখা পাওয়া যায় সপ্তম দশকের আগে নয়। আর দ্রুত অন্যের সঙ্গে মিশে গিয়েও নিজের একটা ইউনিক পরিচয় তৈরি করেছে সে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বোধনের আগের সন্ধে থেকেই আনন্দপ্রস্তুতি তুঙ্গে

Delhi Durga Puja 2018: “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজে উঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধূলির সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন, আজ চিচ্ছক্তি রূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রী বিরণ্ডিতা প্রতিমা, মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা ...”

Advertisment

পিতৃপক্ষের শেষে মাতৃপক্ষের আবাহনে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মেঘমন্দ্র স্বরেই বাঙালির সর্বজনীন বিশ্বজনীন বিশ্বজননীর বন্দনা দুর্গাপূজার আবহাওয়া ঘিরে ধরে বাঙালি মননকে। বারো মাসে তেরো পার্বুণে বাঙালি যখন বাংলার বাইরে আসে তখন বলে, দুই বাঙালি এক হলে ক্লাব খোলে, তিন বাঙালি দুর্গাপুজো শুরু করে, আর চার বাঙালি এক হলে কালীবাড়ি তৈরি হয়।

দিল্লির ক্ষেত্রে যদি সংখ্যাটা ধরতে হয়, তাহলে শহর হিসাবে বাংলা এবং ত্রিপুরা বা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি ছাড়া দিল্লিতেই সর্বাধিক বাঙালি বাস করে। সেই সেবার, ১৯০৫এর ১৯শে জুলাই কার্জন সাহেব যখন অখণ্ড বাংলাদেশকে দুভাগে ভাগ করলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দমাতে। তখন থেকেই তার বিরোধিতা করে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষে ১৯১১য় এসে বিভক্ত বাংলা আবার এক হয়। কিন্তু তদ্দিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। বাঙালির বিরোধিতা আর বিপ্লবী স্বভাবে ভড়কে গিয়ে সাহেবরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল যে ভারতের প্রাক্তন প্রধান শহর দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরন করা হবে। তলে তকে কাজও শুরু হয়ে যায়।

বাঙালিদের মধ্যে এক আশ্চর্য সমাপত্ন দেখা যায়। আধুনিক পরাধীন ভারতে সবার আগে গর্জে উঠেছিল বাঙালি। আবার যখনই বৃটিশ মেশিনারিকে সহায়তার সময় এসেছে, দেখা গেছে বাঙালিই সবার আগে। তা রাজধানী স্থানান্তরিত হবে, কিন্তু ছাপাখানা বা সরকারী কাজ কে করবে? কেন বাঙালি! সেই বাঙালিই ১৯০৬ থেকে রাজধানীতে বৃহৎ সংখ্যায় বসবাস শুরু করে। তিমারপুরের কাছে সরকারী প্রেসের কর্মীদের কলোনি গঠিত হয়। সিবিভ্ল লাইন্স অঞ্চলে সরকারী কর্মীদেরও বসবাস শুরু হয়। আর ফলস্বরূপ দুর্গাপূজা।

এখন তিমারপুরের সরকারী চাকুরেদের দুর্গাপুজো নাকি চাঁদনি চকের একটি মেসে হওয়া দুর্গাপুজো যা পরবর্তী কালে কাশ্মীরি গেটের কাছে বেঙ্গলী ক্লাবে চলে আসে। কোনটি সর্বপ্রাচীন দিল্লির দুর্গাপুজো। আগে রেজিস্ট্রেশন হবার সুবাদে হয়ত কাশ্মীরি গেটের পুজোকেই দিল্লির বাঙালির সর্বপ্রথম সর্বজনীন ধরা হয়। সেটি ১৯১০ এবং তিমারপুরের পঞ্জীকরণ হয় ১৯১৪। কিন্তু তিমারপুরের দুর্গাপুজোর বর্তমান সভাপতি শ্রী সুখাংশু চ্যাটার্জী জানালেন তিমারপুরের পুজো শুরু হয় ১৯০৮এ, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন দেরিতে হওয়ায় এটি দিল্লির দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুজো। এরপর বাকী জায়গাগুলিতে শুরু হয়ে গেল দুর্গাপুজো। নিউদিল্লি কালীবাড়ি, করোলবাগ বঙ্গীয় সমিতি ছুঁয়ে সফদরজং এনক্লেভ মাতৃমন্দির, পশ্চিম বিহারের কালীবাড়ির পুজো বা নিবেদিতা এনক্লেভ, রামকৃষ্ণ পুরমের দুর্গাপুজো, চিত্তরঞ্জন পার্কের বি ব্লক, কে ব্লক, কো-অপেরেটিভ, মেলা গ্রাউণ্ড এবং পকেট ৪০এর পূজো, প্যাটেল নগর পুজো সমিতি, গুরগাঁও দুর্গাপুজা সমিতি, ফরিদাবাদ হয়ে পূর্ব দিল্লির লক্ষ্মীনগর কালীবাড়ি, ময়ূর বিহারের কালীবাড়ি, মিলনী কালচারাল, অন্তরঙ্গ, নয়ডার সপ্তর্ষি সঙ্ঘ বা গাজিয়াবাদের প্রান্তিক, শিপ্রা সানসিটি ইত্যাদি।

publive-image পাত পাড়ার প্রস্তুতি

নতুন পুরনো মিলিয়ে দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নাকি প্রায় সাড়ে ছশো দুর্গাপূজা হয়। আত্মবিস্মৃত বৃত্তের বাইরের বাঙালি এই কটা দিন নিজের উপস্থিতি জানান দেবার জন্য ডালপালা মেলে।

ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন হলেও আজকাল মহালয়া থেকেই পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়ে যায়। এবছর তো কলকাতার শ্রীভূমির পুজো মহালয়ার আগেই উদ্বোধন হয়ে গেল। তবে দিল্লির পুজো শুরু হতে হতে পঞ্চমীই। অবশ্য বিশেষ বিশেষ পুজোগুলোর বিশেষ বিশেষ জয়ন্তী বর্ষে তারও আগে যে শুরু হয়ে যায় না তা নয়।

তবে পঞ্চমীর দিন তোলা থাকে আনন্দমেলার জন্য। বিভিন্ন পুজো সমিতির সদস্যরা নিজেরা রান্নাবান্না করে স্টল দেন এবং সদস্য অসদস্য নির্বিশেষে টোকেন দাম দিয়ে খেয়ে দেয়ে পেট ও মনের ভরসাফুর্তি করেন টরেন।

তবে বেশ কিছুদিন যাবত এক অন্য উপদ্রব শুরু হয়েছে। নবরাত্রির নটি দিন উত্তর ভারতীয় বর্ণহিন্দুরা উপবাস রাখেন। অর্থাৎ নিজেরা সুবিধা মতো দাগিয়ে দিয়েছেন যে শাঁকালুর আটা, আলু ইত্যাদি সবজি টবজি খেয়ে শুদ্ধ জীবন যাপন করবেন এবং দেবীর আরাধনা করবেন। তা মন্দ কি, সকল জাতি উপজাতিরই নিজস্ব ধ্যান ধারণা মতবাদ রয়েছে। এই যেমন উত্তরভারতে পিতৃপক্ষকে শ্রাদ্ধ সময়কাল হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছুই তখন কেনাকাটি হয় না। কিন্তু বাঙালির কথা আলাদা। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে বাঙালি টাইপের লোকের দেখা পাওয়া যায় সপ্তম দশকের আগে নয়। আর দ্রুত অন্যের সঙ্গে মিশে গিয়েও নিজের একটা ইউনিক পরিচয় তৈরি করেছে সে। অকালবোধনকেই সে তার বারোমাস্যার মূল উৎসব হিসাবে গণ্য করে। তার কেনাকাটাও তথাকথিত শ্রাদ্ধ সময়কালেই হয়।

আর আসল উৎসবের সময়? বাঙালির ঘরে হেঁসেল চলে না। উৎসবের পাঁচটা দিন নিজ নিজ দুর্গাপূজা এবং তৎসংলগ্ন খাবার স্টলগুলোতেই দিনগুজরান তার। আনন্দ বলে কথা। তাতে আমিষের ছোঁয়া না থাকলে তো জীবনই বৃথা। ব্যাস এখানেই লেগে যাচ্ছে কালচারাল ক্ল্যাশ বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। গত বছর পূর্ব দিল্লির আই পি এক্সটেনশনের পূর্বাঞ্চলের পুজোর অনুমতি তখনই পাওয়া গেছিল যখন উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে মুচলেকা দেওয়া হয় যে কোন রকম আমিষ রান্না করা যাবে না। এবারও রিপোর্ট আসছে মধ্য দিল্লির গোলমার্কেটের আশেপাশে আমিষ ভক্ষণের উপর তির্যক দৃষ্টির বাধা নেমে আসছে।

তবে এসব নিয়েই তো মানুষ। আর দুর্গাপুজো মানুষের উৎসব। বেঁচে থাকার জয়গান। আর এ থেকেই আরও একটি বিষয় চোখে পড়ছে। তা হল অধুনা দিল্লির পূজামণ্ডপগুলিতে পরিবেশ দূষণ রোধকারী তৎপরতা। তবে এক্ষেত্রে দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন কিছুটা কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। বছর পাঁচেক আগে থেকে তারা পরিবেশ বান্ধব দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রতিযোগিতা চালু করে, পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য। দিল্লির পুজোগুলোর এই সূত্রে সহযোগিতাও অনস্বীকার্য। এখন তাই গুরুত্বপূর্ণ দুর্গাপুজোতে দেখা যায় রাসায়নিক রঙ এবং উপাদানের জায়গায় প্রাকৃতিক উপাদান রঙ ইত্যাদির ব্যবহার। থার্মোকল বিবর্জিত পুজো বা পূজা মণ্ডপেই বিসর্জনের জন্য অস্থায়ী পুকুর করে সেখানে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নদীদূষণ রোধ। দুর্গাপুজো সকলের উৎসবে। ধর্ম জাতি নির্বিশেষে সকলের। সেই পুজোকে কেন্দ্র করে সঠিক সচেতনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নতুন করে অক্সিজেন যুগিয়ে যায়।

আজ ষষ্ঠী, আজ মায়ের বোধন। পুজো পরিক্রমা শুরুর আগে কাল বিকেলের একটি ঘটনা বা গল্পচ্ছটা দিয়ে আজকের প্রতিবেদন শেষ করি। বেশ তিন চার বছর পরে আনন্দমেলায় স্টল দিয়েছি। সকাল সকাল চিকেন কষা রান্না করে ফেসবুকে পোস্টানোও হয়ে গেছে। চিকেন কষার সঙ্গে বাসন্তী পোলাও। সেই মতো পুরনো নতুন গোবিন্দভোগ চাল নিয়ে এসে দুধ আর কিছুটা জাফরান কেশর আর হলুদে ভিজিয়ে রেখেছি চাল। সময়ের একটু এদিক ওদিকে রান্না শুরু করতে দেরি হয়েছে। আর তার সঙ্গে নতুন পুরনো দুরকমের চাল। ব্যাস সাড়ে চারটে নাগাদ দেখি, ডেকচির তলা পুড়তে শুরু করেছে, কিন্তু কিছু কিছু চাল কাঁচা আর বাকিটা গলতে শুরু করেছে। চেষ্টা চরিত্র করেও বাঁচানো গেল না সাড়ে চার কিলো গোবিন্দভোগ। সময় ফুরিয়ে আসছে। শুরু করার সময় কাছে চলে আসছে। শেষে কাছের হোটেলের রাতের জন্য আধ রান্না করা ভাত নিয়ে এসে গরম মশলা ফোড়ন, দুধে জাফরান, ব্রাউন সুগার, নুন আর কাপড় দিয়ে মুড়ে কম আঁচে ডবল বয়লারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মুখ রক্ষা হল বটে, কিন্তু কাঁচা পাকা গোবিন্দভোগ ফেলে দেবার আগে মুখে দিয়ে দেখলাম তার স্বাদ হয়তো হাজার গুণ ভালো ছিল। অথবা এইভাবেই তো চিটিংগুলো শুরু হয়ে যায়। আনন্দমেলায় আনন্দের থেকে পুরষ্কারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তাই বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অর্ডার দিয়ে পেশাদারদের দিয়ে রান্না করে নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে বিক্রির প্রবণতা।

উৎসব শুরু হয়ে গেছে। আশা করছি সকলেরই ভালো কাটবে। আজ অফিস আছে আর আছে একটি আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বিচার। দুপুর বেলা অফিস থেকে প্রায় পঁচিশ কিমি দূরে গিয়ে তারপর আবার অফিসে ফিরে আসা। শেষে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের সূত্রপাতে আগমনীর সুর। আজ মায়ের বোধন সকলের মনে স্ফূর্তি ও ফুর্তি নিয়ে আসুক, নিয়ে আসুক শান্তি ও শুভবুদ্ধি। শুভ হোক মহাষষ্ঠী।

Advertisment