বিশ্বভারতীতে ব্রাহ্ম ধর্ম অনুযায়ী মূর্তি পুজো হয় না। কিন্তু শান্তিনিকেতন লাগোয়া গ্রামের মানুষরাই বা কী করবেন! বোলপুর শহরে পুজো হলেও তা তেমন আকর্ষণীয় নয়। পুজোর ছুটি কাটাতে বহু পর্যটকও আসেন শান্তিনিকেতনে, তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কার্যত ঘরবন্দী হয়ে যান। এই পরিবেশে উৎসবের স্বাদ এনেছে হীরালিনী দুর্গোৎসব। প্রয়াত শিল্পী বাঁধন দাস সোনাঝুরির পাশে বনেরপুকুর ডাঙা গ্রামে চালা করে উৎসব শুরু করেন। শিল্পকলায় অনবদ্য সেই সৃষ্টি এখন নজর কাড়ছে গোটা রাজ্যের শিল্প অনুরাগীদের। কখনও বাঁশ কেটে রঙ করে প্রতিমা কোনবার আবার ঢালাই লোহার অবয়ব, প্রতি বছর পুজো শেষে কোন বিসর্জন নয়, সংরক্ষণ করা হয় প্রতিমা।
বাঁধন দাসের মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র আশিস ঘোষ দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। পুরোনো কোনও প্রতিমায় দেওয়া হচ্ছে নতুন আদল। শিল্প নৈপুণ্যের ছোঁয়ায় প্রতিমা নতুন হচ্ছে প্রতিবার ।
বনেরপুকুর ডাঙা, ফুলডাঙা, সরকারডাঙা, আর বল্লভপুর ডাঙা- মোট চারটি গ্রামের মানুষরা মিলিত হন এই উৎসবে। বাইরে গড়া হয় মঞ্চ। চারদিন গ্রামের যাত্রা পালা চলে। থাকে আদিবাসী শিল্পীদের নাচ গান, সঙ্গে বাউলগান।
শিল্পী বাঁধন দাস নিজেই এক ইতিহাস
হাতে গড়া শাড়ি অলঙ্কার বা বাঁশি কি একতারা সব সম্ভার নিয়ে হীরালিনী দুর্গোৎসব এখন রাজ্যের উৎসবের বাজারে এক নজরকাড়া কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন, শহরের প্রাচীনতম দুর্গাপুজো মলিন, হেলদোল নেই শিলিগুড়ির
তবে যিনি এখানে এই পুজোর প্রচলন করলেন সেই শিল্পী বাঁধন দাস নিজেই এক ইতিহাস ।
একমাথা পাকা চুল, সঙ্গে লম্বা দাড়ি যেন রবি ঠাকুর শান্তিনিকেতনের অদূরে বনেরপুকুর ডাঙায় জঙ্গলের মধ্যে কয়েক বিঘে জমি কিনে নিজের ডেরা বানিয়েছিলেল ২০০০ সাল নাগাদ। বাঁধন দাস ছিলেন কলকাতার সরকারি চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওপার বাংলার মানুষটি শিল্পকলার সাথে জানতেন আরও হরেক বিষয়। যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র। দেশভাগ হওয়ার পরে সীমান্তর সমস্ত উদ্বাস্তু শিবিরে নিজে গিয়ে চিকিৎসা করতেন, রুগীদের ওষুধ দিতেন। বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব সহায়তা করতেন। এই মানুষের পাশে থাকার তাগিদ তাঁকে গুজরাটের দাঙ্গার পরেও তাড়া করেছিল, বলতেন আমি নিজে উদ্বাস্ত পরিবারের মানুষ। শরণার্থীদের যন্ত্রণাটা বুঝি, নীরবে গিয়ে শরণার্থীদের পাশে থাকতেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানির তীব্র বিরোধী ছিলেন।
আবার এই মানুষটা কলেজে এমন ভাবে পড়াতেন যে সময় পার হয়ে গেলেও পড়ুয়ারা তাকে ছাড়তেন না। ছাত্রদের নিয়ে মাঝে মাঝে চলে যেতেন সুন্দরবনের খাঁড়িতে, ভাঙন দেখিয়ে সৃষ্টির তাগিদ তৈরী করাতেন সকলের মধ্যে। কলকাতার কার্জন পার্কে যে ভাস্কর্যটি আছে সেটাও তাঁরই পরিকল্পনা। শিল্পী জীবনে নিজে যেমন বহু সৃষ্টি করেছেন তেমন তার ছাত্রদেরও গড়েছেন এক ভিন্ন মানসিকতায়।
আরও পড়ুন, ঐতিহ্যের দুর্গাপুজো- জলপাইগুড়ির বাগচী বাড়ি
রসিকতা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একবার নিজে বিভিন্ন ফল সংগ্রহ করে সুরা বানানোর চেষ্টা করলেন তাতে সফল হওয়ার পর নিজেই কিছুদিন মেতে থাকলেন তা নিয়ে।
একবার শখ হলো পাহাড় কিনবেন, বহু চেষ্টাও করলেন কিন্তু নানা সরকারি আইন কানুন দেখে হাল ছাড়লেন ।
অদ্ভুত বিষয় বাঁধন দাস ছিলেন কট্টর বামপন্হী এবং ঘোরতর নাস্তিক । সেই মানুষটি কিনা দুর্গাপুজো নিয়ে মেতে উঠলেন! নানা জনের এই কৌতুহল দেখে বাঁধন দাস সাফ বলতেন তিনি কোন ধর্মীয় উপাচার নয় মায়ের পুজো করেন। মা কে শ্রদ্ধা সম্মান জানানোর এটাও একটা পথ তার মতে। তাই তাঁর সৃষ্টি করা প্রতিমায় কোথাও অসুর বধ হয় নি। কারণ হিসেবে তিনি বলতেন “আমি নিজে শিক্ষকতার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কাউকে মেরে বা মারধর করে কোন সমস্যা মেটে না দরকার জ্ঞান ভালোবাসার, মা একজনকে বধ করছে আর তার রক্ত ঝরছে এমন কল্পনা আমার নেই “।
আর তিনি শান্তিনিকেতনের যেখানে ডেরা বাঁধলেন সেখানে তখন মূলত ছিলেন আদিবাসী মানুষরা, তাদেরও মূর্তি পুজো নেই কিন্তু উৎসব আছে। তবে সে উৎসব পালন করার ঠাঁই নেই। বাঁধন দাস সেই জায়গা করে দিয়েছিলেন, এর সঙ্গে শিল্প সৃষ্টির কাজে যুক্ত করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আদিবাসীদের মধ্যে এক সুপ্ত শিল্প সত্তা আছে- তিনি সেই সত্তাকেই জাগিয়ে তুলেছিলেন, আর তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে সেই আদিবাসী যুবকেরা এখন শিল্পী হয়ে উঠেছেন ।
বিচিত্র ভাবনার শিল্পী বাঁধন দাসের জীবন জুড়ে ছিলেন মা, তার দুর্গাপুজা কিন্তু দুর্গোৎসব। তিনি সেই পুজোর নামকরণ করে গিয়েছিলেন তাঁর মা হিরালীনি দেবীর নামে- হিরালীনি দুর্গোৎসব! তাঁর অবর্তমানে সেই দায়িত্ব বহন করে চলেছেন তাঁর ছাত্র আশিস ঘোষ আর এলাকার আদিবাসীরা ।