এবছর একেবারে মাসের প্রথম দিন পয়লা জুলাই, রথযাত্রা পড়েছে। রথযাত্রা মানেই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা। হিন্দুদের চার ধামের অন্যতম শ্রীক্ষেত্র বা নীলাচল অর্থাৎ পুরী। আর, কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়। সবটাই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু, রথযাত্রা যাদের নিয়ে, মানে জগন্নাথ, বলভদ্র আর সুভদ্রা- তাদের ব্যাপারে ভক্তদের কৌতূহলের শেষ নেই।
সাধারণত হিন্দুদের যেমন দেবদেবী আমরা দেখি, জগন্নাথ, বলভদ্র আর সুভদ্রার মূর্তি কিন্তু তার সঙ্গে মেলে না। হিন্দুদের মূর্তি মানেই ভগবান বেশ সাজানো গোছানো, পরিপাটি চেহারার। হাতে অস্ত্র, সঙ্গে বাহন- সে কত কিছু! জগন্নাথদেবেরও তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। বলভদ্র, সুভদ্রারও তাই। কিন্তু, হয়নি। এর অবশ্য একটা বিশেষ কারণ আছে। আছে এক বিরাট কাহিনি।
কথিত আছে ওড়িশার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রথম জগন্নাথ মন্দিরের নির্মাণ করিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। স্বপ্নে জগন্নাথ তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন, নীলাঞ্চল পর্বতের গুহা থেকে তাঁর মূর্তি নিয়ে আসার। রাজা এনিয়ে রাজপুরোহিত বিদ্যাপতির সঙ্গে কথা বলেন। বিদ্যাপতি জানতেন নীলাঞ্চল পর্বতের গুহায় নীলমাধবের মূর্তি লুকিয়ে রেখেছে শবররা। যার পুজো করেন শবরদের দলপতি তথা নীলমাধবের পরম ভক্ত বিশ্ব বসু।
রাজার আদেশে মূর্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিদ্যাপতি বিশ্ব বসুর মেয়েকে বিয়ে করেন। আর, সেই মেয়ের সাহায্যে গুহা থেকে বের করে আনেন নীলমাধবের মূর্তি। বিদ্যাপতি তো আর এসব জানতেন না। তিনি মূর্তি না-পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর ফের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নাদেশ দেন জগন্নাথ। মূর্তি ফের নীলাঞ্চল পর্বতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে রাজার কাছেও ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই স্বপ্ন দেখার পরই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি সেখানে জগন্নাথকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রার্থনা করেন।
আরও পড়ুন- ভারতের একমাত্র মন্দির, যেখানে ঢুকলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন পাথরের মূর্তি
এরপর ফের ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নাদেশ দেন জগন্নাথদেব। স্বপ্নে জানান, দ্বারকা থেকে নিমকাঠের গুঁড়ি ভেসে আসবে। তা দিয়েই তৈরি করতে হবে তাঁর মূর্তি। স্বপ্ন মিলে যায়। পরের দিন ভোরেই কোথা থেকে একটা বিশাল নিমকাঠের গুঁড়ি ভেসে আসে পুরীর সৈকতে। কিন্তু, সেই গুঁড়ি এতই ভারী ছিল যে রাজার সৈন্যরা হাজারো চেষ্টা করেও গুঁড়িটিকে ডাঙায় তুলতে পারেননি। এরপর ডাক পড়ে বিশ্ব বসুর। তিনি এসে একাই কাঁধে করে নিমকাঠটি ডাঙায় তোলেন।
এরমধ্যেই আচমকা কোথা থেকে এসে হাজির হন এক বৃদ্ধ কারিগরও। তিনি শর্ত দেন, কারও সাহায্য ছাড়া একাই মূর্তিগুলো তৈরি করবেন। ২১ দিনের মধ্যে মূর্তি তৈরি করে দেবেন। কিন্তু, মূর্তি তৈরির সময় এই ২১ দিন মন্দিরের দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। রাজা সেই শর্ত মেনে নেন। কিন্তু, এই খবরে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর স্ত্রী গুন্ডিচা দেবীর আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি মন্দিরের দরজায় আড়ি পাততে শুরু করেন।
বৃদ্ধ কারিগর কতটা কাজ করছেন, আড়ি পেতে সেই শব্দ শোনার চেষ্টা করেন। কিন্তু, ভিতর থেকে কোনও শব্দ না-পাওয়ায় গুন্ডিচা দেবীর মনে আশঙ্কা তৈরি হয়। তিনি রাজাকে বোঝান, মন্দিরের ভিতরে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ কারিগর না-খেতে পেয়ে মারা গিয়েছেন। রানির বারবার এমন অভিযোগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শেষপর্যন্ত মন্দিরের দরজা খোলার নির্দেশ দেন।
কিন্তু, ভিতরে হাজারো খুঁজেও কারিগরকে পাওয়া যায়নি। দেখা যায় তিনটি মূর্তি অসম্পূর্ণ। তার মধ্যে জগন্নাথ ও বলভদ্রের অর্ধেক হাত তৈরি হয়েছে। আর, সুভদ্রার হাত এবং পা কোনওটাই তৈরি হয়নি। উপায় না-পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই মূর্তিই প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার অসমাপ্ত মূর্তিতেই রথযাত্রা চলছে। এমনকী, নিত্যপুজোও চলছে ওই মূর্তিতেই।