New Update
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2018/06/Residential-Building-Cover-photo.jpg)
ওপেন আ ডোর প্রকল্পটি শুরু হয়েছে সংহতি অভিযান নামের একটি উদ্যোগের তরফ থেকে। (ফাইল ফোটো- শশী ঘোষ)
বাড়ি বা ফ্ল্যাট খুঁজতে গিয়ে ধর্মীয় পরিচয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় অনেক ক্ষেত্রেই। অবিবাহিত নারী-পুরুষের একসঙ্গে থাকতে দিতে রাজি হন না প্রায় কেউই। কিন্তু স্থিতাবস্থা ভাঙতে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ফেসবুকেই পাওয়া যাচ্ছে ভালো বাসার সন্ধান।
ওপেন আ ডোর প্রকল্পটি শুরু হয়েছে সংহতি অভিযান নামের একটি উদ্যোগের তরফ থেকে। (ফাইল ফোটো- শশী ঘোষ)
তাপস দাশ
ফোনে তাঁর গলা ছিল আর পাঁচজন প্রোমোটারের মতোই। কোন পোর্টাল দেখে ফোন নাম্বার পেয়েছিলাম তা ঠিক স্মরণ নেই। তবে তাঁর নির্মীয়মাণ প্রজেক্ট ছিল চিনার পার্ক অঞ্চলে। ২০১৫ সালের শেষার্ধ্বে তিনি আমার ফ্ল্যাট সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন একটি প্রতিপ্রশ্নে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, "আপনি হিন্দু না মুসলমান?" কেন এ জিজ্ঞাসা, তার উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, মুসলমানদের তিনি ফ্ল্যাট বিক্রি করবেন না। কথা আর এগোয়নি।
আরও বছর বারো আগে। স্থান - যাদবপুর, উদ্দেশ্য - ঘরভাড়া, সৌজন্য - এক বন্ধু। ঘর ও ভাড়া বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক পছন্দের পালা শেষ হওয়ার পরে, মাননীয় ল্যান্ডলর্ড একটি চারপাতার নিয়মাবলী ফতুয়ার সাইডপকেট থেকে বের করলেন। সে চোথার মাঝামাঝি জায়গায় এসে, সম্ভবত ১৪ নং পয়েন্টে, জানা গেল প্রেমিকা অ্যালাওড নয়।
কলকাতার বহু রাস্তা এখন মসৃণ। নিশিরাতেও কলকাতা জাগে। কলকাতা এগিয়েছে। কিন্তু এসব ছবি পাল্টায়নি। না পাল্টানোর কথা জানেন ভুক্তভোগীরা। এই কদিন আগেই এক শিক্ষক বন্ধু যাদবপুরে তাঁর ধর্মপরিচয়ের জন্য ঘরভাড়া পাচ্ছিলেন না। ধর্মীয় পরিচয় মানে এসব ক্ষেত্রে মূলত পদবী। তাঁরা জীবনচর্যায় ধর্মপালন করেন কি না, সে প্রশ্ন বাড়িওয়ালার কাছে অনাবশ্যক।
এবং বিবাহ। বিয়ে করে মারপিট করবেন কিনা, স্ত্রী কে জ্বালিয়ে দেবেন কি না, কিংবা মধ্যরাতে চিলচিৎকারে স্ত্রী স্বামীর কাছে জানতে চাইবেন কিনা এ জীবন নষ্ট করে দেওয়ার কারণ, সেসবও অনাবশ্যক একজন বাড়িওয়ালার কাছে। সাধারণভাবে। সাধারণভাবে শব্দটা লক্ষ্যণীয়।
কারণ সাধারণ নিয়মটা যে নেহাৎই সাধারণ, তা যে সব নয়, একমাত্র নয়, শহর কলকাতা তা দেখাতে চলেছে। বা বলা ভালো দেখাতে শুরু করে দিয়েছে।
আফরোজা খাতুনের ছেলেবেলা কেটেছে বহরমপুরে। সেখানে বাড়ি ছিল তাঁদের। সে বাড়ি ভাড়াও দেওয়া হত। আফরোজার বাবা মা-দের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, অমুসলিম কাউকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া যাবে না। তেমন কেউ কি ছিলেন আদৌ, কোনও ভট্টাচার্য কিংবা গঙ্গোপাধ্যায়রা কি বাড়ি ভাড়া নিতে চাইতেন মুসলমানদের কাছে? আফরোজার মনে আছে, দু একবার এসেওছিলেন হিন্দু পরিবারের মানুষ, যাঁরা ধর্মাচরণ করেন না। কিন্তু তাঁদেরও সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। আফরোজা নিজে এখন শহর কলকাতায়। ভাড়া দেওয়ার মত সংস্থান হয়েছে তাঁর। তিনি বাবা-মা-র পথে হাঁটেননি। সংস্কারকে জয় করেছেন। তাঁর দেওয়া ঠাঁইয়ে মাথা গুঁজতে গেলে ধর্ম বাধা নয়। বাধা নয় সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতির হিসাব।
একটা দরজা খুলুন। বাংলা করলে এরকমই দাঁড়ায়। 'ওপেন আ ডোর' প্রকল্পটি শুরু হয়েছে সংহতি অভিযান নামের একটি উদ্যোগের তরফ থেকে। সারা দেশ সহ এ রাজ্যে যেভাবে ধর্মীয় বিভাজন, এবং বিভাজনের সুবাদে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার যে সংস্কৃতি ক্রমশ বাড়ছে, তা আটকাতে বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করে চলেছে সংহতি অভিযান, জানালেন এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত কস্তুরী বসু। "বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে এ বিষয়টা কতটা জরুরি হয়ে উঠছে, তা ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম। তখনই মাথায় আসে ফেসবুক গ্রুপের কথা। আমাদের সাধ্যানুযায়ী চলতি প্রথায় একটা ধাক্কা দেওয়ার জন্য এই পদক্ষেপ।"
কেমন সাড়া পাচ্ছেন? কস্তুরী জানালেন, ২১ জুন গ্রুপ শুরু হয়েছে, ২৬ জুনের মধ্যে দু'হাজারের বেশি মানুষ জয়েন করেছেন। "এঁদের সবার হয়তো বাড়ি বা ফ্ল্যাট নেই, হয়তো সবাই তা খুঁজছেনও না, কিন্তু এতজন মানুষ নৈতিক সমর্থন তো করছেন!" কস্তুরী জানালেন, তাঁদের গ্রুপে যাঁরা বাড়ি-ফ্ল্যাট সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দিতে চান, তাঁরা ধর্ম বা বিবাহজ সম্পর্ক নিয়ে বাছবিচার করছেন না। এ নিয়ে তাঁদের গ্রুপে স্পষ্ট উল্লেখ করা রয়েছে। একই সঙ্গে গ্রুপের নিয়মে জানানো রয়েছে বাড়ির দালালরা গ্রুপে পোস্ট করতে পারবেন না। যাঁরা ফেসবুকে নেই, কিন্তু এরকম উদ্যোগে আগ্রহী, তাঁদের জন্যেও রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে। একটি গুগল ফর্ম ফিল আপ করে সাবমিট করলেই তা পোস্টেড হয়ে যাবে গ্রুপে। শুধু শহর কলকাতায় নয়, সারা রাজ্যের যে কোনও জায়গাতেই বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা পিজি-র হদিশ দেওয়া এবং পাওয়া যাবে এখানে। সংগঠকদের আশা, কিছুদিনের মধ্যে গ্রুপ নিজে থেকেই চলতে শুরু করবে, কোনও বাড়তি উদ্যোগ ছাড়াই। কারণ এমন বহু মানুষ আছেন, যাঁরা সংস্কার এবং অশুভ প্রচেষ্টার বাইরে অন্য কলকাতা, অন্য রাজ্য, নতুন পৃথিবীতে বাঁচতে চান।