Advertisment

বিদেশের দুর্গাপুজো: নিবাস কিম্বা পরবাস, উমার জাগরণে বাঙালিয়ানাই জাদুকাঠি

দেশে যেমন অনেককেই দেখি বাচ্চার “বাংলাটা ঠিক আসেনা” বলার মধ্যেই একটা আশ্চর্য গর্ববোধ, বিদেশে বরং বিদেশী সিটিজেন বাচ্চাগুলো ইংরিজি টানেই সুন্দর করে বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বে এরিয়া প্রবাসী-র পুজো

কোথাও ব্রিজ ভাঙছে, তো কোথাও মন! শরতের সোনাঝুরি দিনে কাশফুলের বদলে ঘাসফুল উঁকি দেয় জীবন জুড়ে। তবুও পুজো আসে। প্রবাসের দালানে, ঘরের মাটিতে। দুটিতে বহিরঙ্গের পার্থক্য আছে বটে। তবে স্বল্প পরিসরেও আয়োজনে খামতি না রাখারই চেষ্টা করেন সাত সমুদ্দুর পারের মানুষজন, যারা একটু ভালো থাকার আশায় ঘরের সুখ ছেড়েছিলেন একদিন। নাকি সুখের ঘর? পশ্চিমবঙ্গের পুজো যদি ঘরের পুজো হয় তবে তাতে ছিল রাস্তা জুড়ে পুজো প্যান্ডেলের ম্যারাপ বাঁধার ছবি| ছড়িয়ে থাকা বাঁশ ডিঙিয়ে আমরা সব হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা দিতে যেতাম, মনকে বেঁধে। এখনকার বাচ্চাদের মত অত কঠিন গেরো দিতাম না অবশ্য। পিছলে পিছলে কিছুটা পুজোর রোদ ঢুকেই পড়ত পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে। যাদের বাড়িতে পুজো হত, তাদের পুজো অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়ে যেত একরকম। রথের দিনের বৃষ্টিতে ভেজার আগেই তারা ভিজে নিত কাঠামো পুজোর আনন্দে।

Advertisment

একটু একটু করে গড়ে উঠত মূর্তি কারো ঠাকুরদালানে। কলেজে পড়ার সময় আবার হুজুগে বন্ধুরা মিলে হিড়িক তুলে কুমারটুলিতে ঘুরতে যেতাম। মাটির গন্ধ, তুলির টান, মূর্তি গড়ায় নিবিড় মনোযোগী কোন শিল্পীর পেছনে হয়ত ধূসর হয়ে যাওয়া বোর্ডে লেখা, ‘আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত’ । তরুণ রক্তে কেমন জানি প্রশ্নের উল্কি আঁকা হত চুপিচুপি, আমাদের রবিকবিও যদি সেই মহার্ঘ্য “আন্তর্জাতিক” পুরস্কারটি না পেতেন , তবে এই বঙ্গদেশ কি তাঁকেও অতটাই সম্মান বর্ষণ করত? আমরা ঘরের পাশের শিশিরবিন্দুকে তো চিরকাল তুচ্ছই করলুম, যুগটাই “গ্লোবালাইজেশনের”। বিদেশের পুজোতে অবশ্য মূর্তি গড়ার সেইসব ঝক্কি নেই তেমন। বাহনও সীমিত।  প্যাকিং বাক্সে বন্দী হয়ে মা এসে পৌঁছন সমুদ্দুরে ভেসে, কিম্বা হাওয়ায় উড়ে। কখনো মাটির, কখনো অবশ্য ফাইবার গ্লাস কিম্বা পেপার ম্যাশের। কোথাও কোথাও একচালা হয় সেই চেনা বাগবাজারী ছাঁদে। “লন্ডন দুর্গাপুজো এন্ড দসেরা এসোসিয়েশন” অবশ্য জানাল, একবার নাকি ব্রিটিশ মিউজিয়াম আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্র্যাফটস কাউন্সিলের যৌথ উদ্যোগে খোদ লন্ডনে বসেই কৃষ্ণনগরের পটুয়া এনে মূর্তি গড়ে পুজো হয়েছিল । এই বছরেই আবার লন্ডনের অন্যতম বিখ্যাত অটাম ফেস্টিভ্যাল “টোটালি টেমসে” মনজিত সিং হুনজানের তোলা দুর্গাপুজোর চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন । কলকাতায় গঙ্গার তীরে এমনি প্রদর্শনী আমরাও হয়ত করতে পারি কখনো।

আর যেটা বেশ মজার বিদেশের নানান পুজোয়, ম্যাডক্সের আদলে জমাটি শারদ মেলা । রকমারি স্টলের হাতছানি! ‘ম্যাডক্স দুবাই’ দুর্গাপুজো কমিটি তো নামটাই ধার করে নিয়েছে নস্ট্যালজিয়া ফেরানোর জন্য। নিউ জার্সির পুজো “কল্লোল” আবার একে নিজেদের নামেই ডাকতে স্বচ্ছন্দ ‘কল্লোল মেলা’ বলে। লাইভ ফুচকা থেকে শাড়ি গয়নায় ডাইভ-কি নেই! দাম অবশ্য বেশ চড়ার দিকেই। মালয়েশিয়ার অভিযান রিক্রিয়েশন, ম্যাডক্স দুবাই এরা জানাল নিজেদের হাতে রান্না করা বিরিয়ানী, মোগলাই, এগরোলের মত খাবার নিয়ে স্টল দেওয়ার কথা।

পুজোয় লোকের ভিড় একশ থেকে পাঁচ হাজারে পৌঁছে যায়। অনেকে অবশ্য ইচ্ছে থাকলেও জায়গা কুলোয়না বলে রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। কারণ এখানে তো আর পুজো তেমন সেই বিশাল মাঠ জুড়ে হওয়ার অবকাশ নেই । বেশিরভাগই কমিউনিটি হল কিম্বা স্কুলে। সেদিন থেকে ব্যতিক্রম হংকং শহরের বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের বারোয়ারি পুজো। মন্ডপ বানিয়ে ইন্ডিয়ান রিক্রিয়েশন ক্লাবের খোলা মাঠে পুজোর আয়োজন করেন এনারা। জুরিখে আবার পুজোর হলের বাইরে রীতিমতো কারুকাজ করে লেখা হয় ‘সার্বজনীন দুর্গাপুজো’।

publive-image বিদেশে পূজ্যতে

মনে পড়ে যাচ্ছিল সেইসব আমাদের খোলা আকাশের নিচের পুজো প্যান্ডেলের বাইরে লম্বা লম্বা লাইন, দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভলান্টিয়াররা। আর পাশে পাশে বসেছে পসরার ডালি নিয়ে লোকজন। মনে হত সব কিনে ফেলি, সবকিছু খেয়ে নি। বেলুন, ভেঁপু, ক্যাপফাটানো বন্দুকে বন্দী করে মুঠো মুঠো খুশি নিয়ে ঘুরতাম হাতে। কখনো বা ভিড়ের ধাক্কায় ফেটে যেত কিম্বা  একটু তাল বুঝলেই উড়ে যেত উঁচুতে বেলুনটা। মা কিম্বা বাবা বলত, “আর একটা কিনবি”? আমরা অনেকেই সেদিন বেশ কায়দা করে বলতাম, “আর লাগবেনা”। আমরা আসলে জানতাম, মা বাবারা প্রতিবার পুজোয় নতুন জামা কেনেনা। পুরনো তাপ্পিদেওয়া জামাপ্যান্ট আর শাড়ি কেচে ইস্ত্রি করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায় আমাদের। বিদেশে অবশ্য ততটা টানাটানির ছবি আমার চোখে পড়েনি কোনদিন। সাধ আর সাধ্যের ফারাক কমানোর জন্যেই তো এতদুরে আসা! তবে যেটা খুব অদ্ভুত, সেটা হল বিদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে বাঙালি শিকড়ের অবস্থান। হয়ত মাবাবারা নিজেরা সবসময় একটা ফেলে আসা বাঙালিয়ানায় ভোগেন বলে বাচ্চাগুলোকে নিজেদের সংস্কৃতি ভুলতে দিতে চাননা। দেশে যেমন অনেককেই দেখি বাচ্চার “বাংলাটা ঠিক আসেনা” বলার মধ্যেই একটা আশ্চর্য গর্ববোধ, বিদেশে বরং বিদেশী সিটিজেন বাচ্চাগুলো ইংরিজি টানেই সুন্দর করে বাংলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। চিরন্তন সেই নাচের গান ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’র সুরে পা মেলায় ছন্দে। আমাদের ছোটবেলার সেই আবৃত্তি, বেসুরো হারমোনিয়ামে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া সেগুলোর মত এবড়োখেবড়ো না হলেও মূল ধারাটা কিন্তু একইরকম । নাচগানের কথা উঠলে বলতেই হয় বিদেশের পুজোর কালচারালের কথা। ঠিক যেন পাড়ার পুজো ফাংশন। কেতার ফারাক থাকলেও উদ্দীপনায় কোন অমিল নেই। যেই আকুলতায় একদিন আমরা মিস জোজোকে ধরতে চাইতাম, নিউ জার্সির গার্ডেন স্টেট কালচারালের (GSCA) পুজোয় গত বছর দেখেছিলাম একই উন্মাদনায় বাড়িয়ে দিচ্ছে সবাই তাদের হাত অনুপমের দিকে । বিদেশে অনুষ্ঠান করতে এসে বাঙালিদের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য আর জাতীয় পুরস্কারজয়ী ইমন চক্রবর্তী। এই বছরেও প্রচুর প্রোগ্রাম করছেন দুজনেই বিশ্বজুড়ে। ভৌগোলিক দূরত্ব বাদ দিলে দেশ আর বিদেশের পুজোতে যে বিশেষ তফাত নেই আদর আর যত্নে, শ্রোতাদের ভালবাসায় ভেসে যেতে যেতে জানালেন দুই শিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে কমলিনী আবার ক্যালিফোর্নিয়াবাসী হলেও যতটা আমেরিকায় থাকেন, গানের সূত্রে তার চেয়ে বেশি থাকেন কলকাতায়। পুজো নিয়ে কথা উঠতেই উচ্ছসিত, মনে করেন সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও দেশের পুজোকে সুন্দরভাবে “রিক্রিয়েট” করা হয় বিদেশে। অনুষ্ঠানে ছোট বড় সেলেবরা থাকলেও স্থানীয় ট্যালেন্টকে তুলে ধরার চেষ্টা, পুজো কমিটি মেম্বারদের নাটক এসবের চমৎকার  চল রয়েছে বিদেশে। অনেকে অবশ্য বলিউডকে বিরতি দিয়ে পুজোর সময় একটু অন্যকিছু করতে চান। যেমন ক্যালিফোর্নিয়াতে বে এরিয়া প্রবাসীর পুজো মণিপুরী নৃত্যশিল্পী সঞ্জীব ভট্টাচার্যর নির্দেশনায় আফ্রিকান, ফিলিপিন্স, চাইনিজ ইত্যাদি বিদেশী নাচের সাথে আমাদের চেনা ছৌ, গাজন মিশিয়ে দিয়ে জল, মাটি আর আকাশকে থিম করে চমৎকার একটি নৃত্যানুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেছেন। পুজোর ম্যাগাজিনও সব পুজোরই একটি মূল আকর্ষণ। নিউ জার্সির কল্লোলের ম্যাগাজিনে সুনীল, শক্তি, সঞ্জীব চাটুজ্যে কেইবা লেখেননি? পূর্ণেন্দু পত্রী এঁকেছেন প্রচ্ছদচিত্র। অনেক পুজোতে আবার আছে থিম মেনে ফ্যাশন শোয়ের চল কিম্বা বসে আঁক, শাঁখ বাজানো, উলুধ্বনি ইত্যাদি প্রতিযোগিতা।

পুজোকে বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যদের মাঝেও যাতে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে অনেক পুজোয় তাই লোকাল স্কুলের বাচ্চাদের আমন্ত্রণ করা হয়। জুরিখের পুজোয় যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে স্থানীয়রা, এমনকি বিদেশ থেকে ইউরোপ ঘুরতে আসা টুরিস্টরাও ভিড় করেন।

দুদিন থেকে পাঁচদিনের পুজোয় সাত্ত্বিক মতে খিচুড়ি, বেগুনী, লাবড়া ইত্যাদি ভোগের পাশাপাশি মেনুতে থাকে দশমীর মাটন ছাড়াও মালাই কোপ্তা, শাহী পনির, চিকেন কারী, রসগোল্লা, রসমালাই, বিরিয়ানী, গুলাবজামুন এমনকি মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মাছের ঝোল আর চমচমে বাঙালি তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে আয়েশ করে।

কঠোরভাবে নির্ঘন্ট মেনে পুজো করার চেষ্টা হয় অনেক জায়গাতেই। অনেক জায়গায় দেশ থেকেই পুরোহিত আনা হয়, কখনোবা আসে ঢাকি। ভারত সেবাশ্রম, বেলুড় মঠের পুজো এসবে নিষ্ঠা মেনে আরতি আর পুষ্পাঞ্জলির জন্য অগণিত মানুষের ভিড় জমে। প্রবেশমূল্য নেই, ভোগ বিতরণ অবাধ। জার্মানির স্টুটগার্টের পুজোতে আবার অনলাইন অঞ্জলির ব্যবস্থাও আছে।  ঘরোয়া পুজোয় আছে মনের আরাম ।

তবে শুধু ধুনুচি কিম্বা সিন্দুরখেলায় শোভাবর্ধন নয়, নরওয়ের অসলো কিম্বা সান্টা ক্লারার “উওম্যান নাও” টিভি আয়োজিত পুজোতে কিন্তু মহিলারাই মুখ্য উদ্যোক্তা। “উওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট”য়ের সবচেয়ে বড় প্রতীক তো মা দুর্গা স্বয়ং।

অতএব বোঝাই যায়, রূপে ভোলানোর মরিয়া চেষ্টা নয়, আত্মার আহবানে আর জিয়া নস্ট্যালের দাপটে দেশ বিদেশের পুজো কোথাও যেন একই বহতা নদীর এপার আর ওপার। আর সেই নদীটির নাম বাঙালিয়ানা, থুড়ি বং কানেকশন!

Durga Puja 2019
Advertisment