/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/07/COVER-Photo-1.jpg)
এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
গত ৩রা জুলাই এই প্রথম সমকামী যুগলের বিয়ের অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিল কলকাতা। প্রেমের শহরে চারহাত এক হল দুই প্রেমিকের। সঙ্গী চৈতন্য শর্মার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক রায়। ধর্মীয় নিয়ম-আচার মেনেই মধ্য কলকাতার এক হোটেলে সারা হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। তাঁদের বিয়ের ছবি রীতিমত ভাইরাল নেট দুনিয়ায়। বিয়ের প্রায় এক মাস হতে চলল। দক্ষিণ কলকাতার একটি আবাসনে দুজনের পরিপাটি করে গোছানো ঘরদোর। কেমন কাটছে অভিষেক এবং চৈতন্যের সংসার। খোঁজ নিল ie-Bangla, শুনল তাঁদের বিয়ের অভিজ্ঞতা।
তোমাদের প্রেমের জার্নিটা কীভাবে শুরু হল?
অভিষেক- আমাদের জার্নিটা দেখতে গেলে পিক লকডাউনের মাঝখানে। ফেসবুকে আমাদের আলাপ আর আমরা ফেসবুকেই কথা বলতে শুরু করেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একে অপরকে জানতে শুরু করি। আস্তে আস্তে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার থেকে ভিডিও কল। তারপরই আমি ওকে একদিন, ওতো কলকাতার ছেলে নয়। এমনি খেলার ছলেই বলেছিলাম তুমি কখনও কলকাতা দেখেছ? যদি না দেখে থাকো,'ইউ কাম টু কলকাতা এন্ড বি মাই গেস্ট' তার উত্তরে সে কলকাতায় জানুয়ারির শেষে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে ২০২১ সালে। তারপর থেকে এভাবেই শুরু। ও এখানে দু'সপ্তাহ ছিল। আমি আবার ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ওর ফ্যামেলির সঙ্গে আলাপ হল। প্রথম থেকে আমরা বেশ খোলামেলা ছিলাম। খুব রোম্যান্টিকভাবে চৈতন্য আমায় তাজমহলের সামনে হাঁটু গেড়ে প্রপোজ করেছিল। এরকম প্রপোজের প না বলার কোন কারণই ছিল না। সেই থেকে আমাদের জার্নিটা শুরু বলতে গেলে।
চৈতন্য- প্রথমবার আমি যখন কলকাতায় আসি কলকাতায় সবাই আমাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, আমার অভিষেককে জানতে অনেক সহজ হয়েছিল। এরপর অভিষেক আমার সঙ্গে দেখা করতে গুরগাঁও আসে আমার ফ্যামেলির সঙ্গে দেখা করে। তখনই আমি আগ্রা যাওয়ার প্ল্যান করি তাজমহলের সামনে প্রপোজ করি বিয়ের জন্যে। এরপর অভিষেক আমার ফ্যামেলির সঙ্গে ম্যাচুয়ারলি যেভাবে কথা বলেছিল তাতে সবাই রাজি ছিল। এছাড়া অভিষেকের ফ্যামেলিতেও প্রেম, বিয়ে নিয়ে কোনও সমস্যায় ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে বিয়ের প্ল্যানিং শুরু করি। আফকোর্স এখন সব ঠিকই আছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/07/Inline-PHOTO-1.jpg)
দু'জন ছেলে একে অপরকে বিয়ে করবে এটি তোমারা তোমাদের ফ্যামেলিতে জানানোর পর তাঁদের কি প্রতিক্রিয়া ছিল?
অভিষেক- খালি বাঙালি নয় 'ইন জেনারেল লাইক অ্যা মেজরিটি অফ ইন্ডিয়ান পপুল্যাশেন' এই ধারণাটুকু নেই সমকামী বিয়ে বা সমলিঙ্গের মানুষদের মধ্যে কোন বিয়ে সম্পর্ক হতে পারে এটা মেনে নিতেই পারে না। তো আমার তরফ থেকে ফ্যামেলিকে কনভিন্স করানোর প্রশ্নটাই ওঠেনি তার কারণ আমি আমার মা বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। এছাড়া আমার ভাই বোন সকলেই জানতো আমার বিষয়ে। নাইন্টি পারসেন্ট মানুষ আমায় সাপোর্ট করেছে। তবে হ্যাঁ! বড় হওয়ার সময় স্কুলে বুলি হওয়া লোকজনের টিটকারি আমায় সবই শুনতে হয়েছে। আমি নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি। তখন সময়টা অনেক কঠিন ছিল। চৈতন্যও এটা নিয়ে বলতে পারবে।
চৈতন্য- অভিষেক আর আমার মধ্যে দশ বছরের পার্থক্য রয়েছে। অভিষেকের স্কুলিং ছিল নব্বইয়ের দশকের, আমার কুড়ির। দশ বছরের এই পার্থক্যে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি মানুষের মন মানসিকতার। অভিষেক যেমনটা বলে, ওর স্কুল টাইমে যেভাবে বুলি করা হয়েছিল আমার সঙ্গেও করা টিটকারিরও কোন পার্থক্য ছিল না। টোয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরিতে দাঁড়িয়েও আমরা এখনও আমাদের আইডেন্টিটি নিয়ে কথা বলছি, ইটস এ স্যাড রিয়্যালিটি। আমাদের সোস্যাইটিতে এখনও খোলামেলাভাবে এই বিষয়ে কথা বলে না। আর পাঁচজন ট্রান্স কমিউনিটির মানুষের মতনই আমরা অনেকরকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমি যখন আমার ফ্যামিলিকে জানায়, তারা বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল তবে পরবর্তীতে সব নর্মাল হয়ে যায়। নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজে যা করছো তার উপর ভরসা রাখতে হবে। পরিবারকে বোঝাতে হবে আমি যাতে খুশি থাকবো তাই করা উচিত। সময় লাগবে, তবে হ্যাঁ! সব কিছুর শেষে সব ভালোই হয়েছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/07/Inline-PHOTO-2.jpg)
চৈতন্য কোলকাতায় তোমার কেমন লাগছে?
চৈতন্য- কলকাতা ভালোবাসার শহর। বিয়ের পর থেকে যে ধরণের মেসেজ আসছে তাতে ভীষণ ভালো লাগছে। কলকাতা মানে সিটি অফ জয় কলকাতা সিটি অফ জয়। প্রাণবন্ত একটা শহর।
স্কুল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত তোমাদের চোখে সমাজের কি কি পরিবর্তন ধরা পড়েছে?
চৈতন্য- আমার স্কুলের সময় তো বটেই আমরা যদি নব্বইয়ের দশকের কথা বলি অভিষেকের স্কুলের সময়তেও সমকাম বিষয় নিয়ে কারো কোন ধারনায় ছিল না। ইন্টারনেট কানেকশন এতটা ভালো ছিল না। এখন যেমন বলিউডে কিংবা ওটিটি প্ল্যার্টফর্মে এই টপিকের উপর ছবি তৈরি হচ্ছে। সবাই খোলামেলা ভাবে কথা বলছে যা খুবই ভালো আমাদের কমিউনিটির জন্যে। এখন প্রাইড মান্থ পালন করা হচ্ছে যত আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলবো বাড়ির লোকদের সঙ্গে নিয়ে আলোচনা করবো ততই এই বিষয়টি নর্মাল হয়ে যাবে। হ্যাঁ আফকোর্স বদল ঘটছে ধীরে ধীরে নতুন কিছু ঘটার আগে পিছনে স্ট্রাগ্যাল থাকে। যত তাড়াতাড়ি মানুষ জানবে বুঝবে তত ভালো।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/07/Inline-PHOTO-3.jpg)
বিয়ের প্রায় একমাস হতে চলল, কেমন কাটছে দিনগুলো?
অভিষেক- সময় কাটছে বলতে লাস্ট ডিসেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত এই ছ'টা মাস আমাদের দুজনের বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করতে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও যাওয়া। নানা লোকের সঙ্গে দেখা করা, কখনও ক্যাটারার, ফটোগ্রাফার কখনও আবার ভ্যানুতে গিয়ে দেখা এভাবেই কেটে গিয়েছে। বিয়ের পর অবশ্যই যে যার কাজে ফিরে গিয়েছি, ওর এখনও পর্যন্ত ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলছে বলে এখনও বাড়ি থেকে কাজ করছে। আমি আমার ইউনিভার্সিটিতে বেড়িয়ে যায়। এই মাসের শেষ থেকে ও গুরগাঁও ফিরে যাবে। আমি বাড়ি ফিরে এলে এক সাথে ছবি দেখি। ঘুরতে যাই। খাবার বানাই। আর পাঁচটা সাধারণ কাপলের মতো আমরাও একইভাবে দিন কাটাচ্ছি। এই একসাথে থাকার মধ্যে দিয়ে একে অপরকে জানতে পারছি।
চৈতন্য- গত এক দু বছর ধরে কলকাতায় আসা যাওয়া লেগেই আছে। আমার পরিবারের সকলে যে স্পেস দিয়েছে মা নিজেই বলেছে তুমি যাও অভিষেকের সঙ্গে থাকো একে অপরকে জানো তাতে আমার খুব ভালোই হয়েছে। এখানকার মানুষ মনের দিক থেকে অনেক বড়। আমাদের সম্পর্কটাকে যেভাবে মেনে নিয়েছে তাতে এখন খুব ভালোই লাগছে।
দুজনের মধ্যে ঝগড়া হলে কে কার রাগ ভাঙ্গাও?
অভিষেক- (প্রশ্ন শুনে চৈতন্য পাশ থেকে হেসে ওঠে) সেটা আমিই করি, বেশিরভাগ সময় আমি রাগটা ভাঙ্গায়। আমি ঝগড়াটা বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারি না। বেশিরভাগ সময় রাগারাগিটা আমিই করি ও ভীষণই শান্ত। ওকে রাগানোটা বেশী মুশকিল। আমার চট করে রাগ হয়ে যায়। রাগারাগিটাও আমিই করি ঝগড়াটাকেও আমি চট করে ঠাণ্ডাও আমি করি।
চৈতন্য- যত তাড়াতাড়ি রাগ হয় অভিষেকের তত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডাও হয়ে যায়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/07/Inline-PHOTO-1.jpg)
দুজনের খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ আলাদা, কীভাবে পুরো ব্যাপার ম্যানেজ করা হয়?
অভিষেক- ও আমার লাইফে আসার আগে ছ'বছর আমি একা ছিলাম। রান্নাটা করতে জানি আমার বাবা খুব ভালো রান্না করতেন আমার দিদাও ভালো রাঁধুনি ছিলেন আমি তাদের থেকে আমার রান্নার হাত পেয়েছি আমার নিজেরও রান্না করতে খুব ভালো লাগে। ও যেমন পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ান আমার প্লাস পয়েন্ট যেমন আমি এর আগে কোনও ভেজিটেরিয়ান রান্না করতাম না জানতামই না। এখন কিছু ভেজিটেরিয়ান রান্না বাঙালি স্টাইলে করে খাওয়ায় কিছু কিছু রান্না ওর ভালও লাগে কিছু ভালো লাগে না এমনটাই হয়। 'হি লাভস আলু পোস্ত, ধোকার ডালনা, বেগুন বড়ির ঝোল'। আমি ওকে কখনও জোর করে বলি না আজ মাছ খেয়ে নাও বা মাংস খাও ঠিক তেমনি ও আমাকে বলে খাবারের ব্যাপারের দুজনের মধ্যে এই সমঝোতাটা রয়েছে।
চৈতন্য- লাকিলি আমরা দুজনেই রান্না করতে পারি তাই রান্নাটা ম্যানেজ হয়ে যায়।
বিয়েতে আমন্ত্রিত কারা ছিলেন?
অভিষেক- বিয়ের দিনে আমার পরিবারের কাছের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন তো ছিলই এছাড়া আমার যাদের মনে হয়েছে যারা আমার এই আনন্দের অংশীদার হতে চাই যাদের আশীর্বাদ সত্যিই কাম্য ছিল এমনই অফিসের কিছু বন্ধুবান্ধব, ওর দিল্লীর বন্ধুবান্ধব অফিসের কলিগ সকলেই এসেছিল। একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান ছিল কিছু মানুষকে নিয়ে।
চৈতন্য- হ্যাঁ, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই এসেছিল।
তোমাদের দুজনের কাছে বিয়ের সংজ্ঞাটা কি?
অভিষেক- বিয়ে জিনিসটা আমার কাছে মনে হয় দুটো মানুষের একসঙ্গে আসা সামাজিক স্বীকৃতি। লোককে জানানো আমরা একে অপরকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পছন্দ করেছি। আজকালকার দিনেই অনেকেই লিভ ইন করে স্ট্রেট, গে, বাইসেক্সুয়াল, আমাকেও অনেকে জিজ্ঞেস করতো হ্যাঁরে তুই সেটল করবি না! কিন্তু আমার যতক্ষণ পর্যন্ত সঠিক মানুষের থেকে সঠিক সিগন্যালটা পাওয়া যায় ততক্ষণ কোন সিদ্ধান্তে না যাওয়া ভালো। আমি চৈতন্য যখন পেয়েছি তখন মনে হয়েছে এবার সেটল হওয়া যায়। বিয়ে মানে দুজন মানুষ নয়, দুজন মানুষের আত্মার মিলন।
চৈতন্য- বিয়েটা আমার কাছে দরকারি ছিল তার কারণ সামাজিক স্বীকৃতির জন্যে। আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আছে বা বয়ফ্রেন্ড আছে সেটা আলাদা বিষয় আপনার পরিবারের থেকে কোন নিমন্ত্রণ পত্র এলে ওখানে আপনার নামের পাশাপাশি পার্টনার নাম থাকলে সেটা অনেক বেশী ভালো লাগে। বিয়েটা আসলে দুটো মানুষের মনের মিলন এখানে জেন্ডারের কোনো ভূমিকা নেই। আমাদের বিয়েতে পুরোহিত মশায় বলেছিলেন, সাধারণত বিয়েতে লক্ষ্মী আর নারায়ণ থাকে আপনাদের বিয়েতে দুজনেই নারায়ণ। উনি এত সুন্দর করে পুরো বিষয়টিকে বুঝিয়েছিলেন আমাদের ভালো লেগেছিল। বিয়েটা দুজন মানুষের মধ্যে সব ভাগাভাগি করে নেওয়া এমন একজন কেউ থাকা যার সাথে সব কিছু শেয়ার করা যেতে পারে। দিনের শেষে কেউ একজন আছে যে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছে।
বিয়েটা কীভাবে হয়েছে বাঙালি নাকি অবাঙালি মতে?
অভিষেক- যদি শুধুমাত্র বিয়েটা বলা হয় তবে বিয়েটা বাঙালি মতেই হয়েছে। তবে বিয়ের বাকি সব আচার অনুষ্ঠান বাঙালি অবাঙালি দুটোতেই হয়েছে। যেমন একদিকে বাঙালি মতে আশীর্বাদ হয়েছে অন্যদিকে অবাঙালি মতে তিলক হয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের গায়ে হলুদ দুজনের একসাথেই হয়েছে দুজনের পরিবারই দুওকম কালাচারের সাক্ষী ছিল। বিয়েটা দুরকম নিয়িমে করতে গেলে অনেকটা সময় প্রয়োজন হত তাই বিয়েটা বাঙালি নিয়মেই হয়েছে।
চৈতন্য- এমনিতেই বিয়ের সব নিয়ম বলতে একইরকম ছিল খুব বেশী পার্থক্য ছিল না।