বাড়ি-ঘর, পুকুর, জমি সবই আছে, শুধু মানুষ নেই। নাম বেনাগ্রাম। অবস্থান কর্পোরেশন এলাকায়। কিন্তু ভূতের গ্রাম বলেই একডাকে সবাই চেনে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধি সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এলেন এই গ্রামের।
জঙ্গল-ঝোপ-আগাছায় ঢেকেছে আস্ত একটা গ্রাম। ঢুকলেই যেন গা ছমছমে ব্যাপার। জনপদের অস্তিত্ব বলতে সারি সারি কঙ্কালসার পাকা বাড়ি। সব বাড়িই ফাঁকা। কোনও বাড়ির আবার ছাদ নেই। জানালা-দরজা বলেও কিছু অবশিষ্ট নেই। বাড়ির ঘুলঘুলিও ফাঁকা। বহুবছর কারও পায়ের ছাপ পড়েনি একসময়ের এই ছোট্ট জনপদে। গ্রামের মানুষ না কি ভূতের ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন। অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন। মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছে ভূতের গাঁ বেনাগ্রাম। গ্রামের গা ঘেঁষে কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা। তবুও গ্রামে ফেরার তাগিদ নেই বাসিন্দাদের।
পশ্চিম বর্ধমানের নিয়ামতপুরে জিটি রোড থেকে রূপনারায়নপুর যাওয়ার পথের ধারেই একরত্তি গ্রাম। খুব বেশি না হলেও শদুয়েক মানুষের বসতি ছিল এই গ্রামে। পাকা বাড়ির সংখ্যাই বেশি। এখানকার বাসিন্দারা কেউ চাকরিজীবী, কেউ বা ব্যবসায়ী। তাঁদের আর্থিক অবস্থা যে মন্দ নয়, তা বাড়িগুলোর চেহারা দেখলেই বোধগম্য হয়। গ্রামের ভিতরে রয়েছে বড় পুকুর। কৃষিযোগ্য জমিও। আগে ছিল কুল্টি পুরসভার অন্তর্গত। এখন আসানসোল পুর নিগমের ৬১ নম্বর ওয়ার্ডে পড়ছে এই বেনাগ্রাম।
আরও পড়ুন: ভগবানরূপী নিজ মূর্তিতে সাধনা কলি যুগের স্বঘোষিত ত্রাতার
গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে আসানসোল-ধানবাদ রেললাইন। এখন জঙ্গলের আড়ালে রেললাইনও ঠাওর করা যায় না। গ্রাম দেখলে মনে হতেই পারে এ বুঝি হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার কোনও ধ্বংসাবশেষে। এখানে বছরে একবার আলো জ্বলে। একদিনের জন্য গ্রামে ফেরেন বাসিন্দারা। তবে নিজেদের বাড়িগুলো চোখের দেখা দেখেন। এর বেশি কিছু নয়। কোনও ভোট এলে বুথ হয় পাশের ডেইডি গ্রামে। অতএব তখনও গ্রামে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। শুধু লক্ষ্মীপুজোর দিন এখানে আসেন তাঁরা। সারা বছর কারও দেখা মেলে না।
ভূত তাড়ানোর বিশেষ পরিকল্পনা নিতে চান আসানসোল পুরনিগমের ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আদিনাথ পুইতুন্ডি। তাঁর দাবি, "ইচ্ছে করেই ভূতের গল্প ছড়ানো হয়েছে। এখনই ওখানে বিপিএলের জন্য একশোটা ঘর তৈরি করলেই ভূত-প্রেত সব পালিয়ে যাবে। গ্রামের লোক জায়গা দান করলেই বিপিএলের ঘর তৈরির কাজ শুরু করে দেব। শুধু তাই নয়, ওই এলাকায় দুএকটা ফ্ল্যাট হলেই জায়গার দাম হয়ে যাবে কাঠা প্রতি ১০ লক্ষ টাকা। তখন ওঁরাই জায়গা বিক্রি করতে তৎপর হবেন। এখনই দালাল ধরে জায়গা বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে।"
গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, একেবারে জনমানব শূন্য। পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। আগে রাস্তা ছিল মাটির। এখন কংক্রিটের হয়েছে। গ্রামে রয়েছে একটি লক্ষ্মী মন্দির। রহস্য উদ্ঘাটনে নানা কাহিনী উঠে এল। ১৫ বছরের বেশি কেন এইসব পরিবার গ্রাম ছেড়েছেন? কেন ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র বাস করছেন? গ্রামের লাগোয়া রেললাইন। আর পাঁচটা গ্রামের মত এখানকার বাসিন্দারাও সুস্থ জীবনযাপন করতেন। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা স্কুলেও যেত নিয়মিত। সন্ধ্যেবলা শাঁখের আওয়াজ ভাসতো বাতাসে। কিন্তু কারও কারও অভিসন্ধি ছিল অন্য। গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল পরিকল্পনা করেই।
রেললাইনের পাশে খুন করে দেহ ফেলে রেখে পালাত দুষ্কৃতীরা। একবার দুবার নয়। বারে বারে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। খামোখা নিত্যদিন পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হত। দুষ্কৃতীরা দেহ রেখে যেত, তার হ্যাপা পোহাতে হত বাসিন্দাদের। তাছাড়া ওয়াগন ব্রেকারদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তাঁদের স্বাভাবিক জনজীবন। কালক্রমে ভূতের গল্প রটতে শুরু করে।
এসব বললেও কিছুতেই নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না গ্রামে ঢোকার মুখে দোকানে মুড়ি চিবোতে থাকা পাকা দাড়ির জনৈক ব্যক্তি। তাঁর বক্তব্য, "অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল গ্রাম সংলগ্ন এলাকা। সকালে উঠেই লাশ দেখা অভ্যাস করে ফেলেছিলেন গ্রামের মানুষ। ছোটখাটো চুরিচামারি তো ছিলই। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার সবরকম চেষ্টা হয়েছিল। একই সঙ্গে ভুতের ভয় দেখানোও শুরু হয়ে যায়। রাত হলেই নানা ধরনের শব্দ শুনতে পেতেন গ্রামের মানুষ। উন্নয়নের ছোঁয়াও কিছু ছিল না। সব মিলিয়ে ছোট্ট গ্রামের মানুষগুলো গ্রামে থাকার ঝুঁকি নেননি। একে একে সবাই অন্যত্র বসবাস শুরু করেন।" ক্রমশ গ্রাম জনমানব শূন্য হতেই ভূতের গ্রামের তকমা জুটে যায়। এখন রাস্তা হয়েছে, ইলেকট্রিকের পোস্ট বসেছে। কিন্তু মানুষ বাস করে না।
গ্রামে ঢোকার মুখেই চা-জলখাবারের দোকান রাজেশ দাসের। রাজেশ বলেন, "ভূতের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গিয়েছেন। তবে প্রতিদিন এখানে লাশ ফেলে যেত বলেও গ্রামের মানুষ ভয় পেত। চোরের উপদ্রবও ছিল।"
আদিনাথবাবু বলেন, "সবাই বলেছিল রাস্তা হলে গ্রামে চলে আসব। রাস্তা হল, বেড়ে গেল জমির দাম। জমি হাঙররা উঠে পড়ে লেগেছে। গ্রামের একজনও ফেরেনি। কুল্টি, আসানসোল, এমনকি পাশের গ্রামেই বাস করছে। কয়েক ঘর এলেই ইলেকট্রিকের লাইন দিয়ে দেব। আসলে এঁরা চাইছেন চড়া দামে জায়গা বিক্রি করতে। ৬৫ লক্ষ টাকা খরচ করে এডিডিএ রাস্তা করেছে। কিন্তু কোনও ফায়দা হল না। লক্ষ্মীপুজো এলেই শুধু গ্রামের কথা মনে পড়ে।"