Advertisment

ভূত চতুর্দশীর মরসুমে ভূত দেখতে হাঁটবেন নাকি ঘোস্ট ওয়াকে?

এ শহরের হেরিটেজ বাড়িগুলোর অন্দরের ভূতুড়ে কাহিনি আজও রীতিমতো হট কেক। কলকাতার সেইসব ভূতুড়ে কাহিনির উপর ভর করেই রুজিরুটি অনেকের। যাঁরা কিনা গভীর রাতে 'ঘোস্ট ওয়াক' করান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ghost walk, ঘোস্ট ওয়াক

রাতের শহরে ঘোস্ট ওয়াক। ছবি: লেট আস গো

নিঝুম রাত, শহর তখন ডিনার সেরে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু ওঁদের চোখে ঘুম নেই। রাতের অন্ধকারে স্ট্রিট লাইটের টিমটিমে আলোয় ওঁরা নির্ভয়ে হাঁটেন এবং হাঁটান। ইচ্ছুক সঙ্গীরা ডিনার সেরে তল্পিতল্পা বেঁধে গাইডের হাত ধরে হাঁটতে বেরোন। এ তো শুধু হাঁটা নয়, তেনাদের দর্শনলাভের আশাও। আক্ষরিক অর্থে চোখে দেখা যায় না হয়তো, কিন্তু গাইডের মুখে অত রাতে থমথমে পুরনো বাড়িতে আলো-আঁধারিতে তেনাদের কাহিনি শুনতে শুনতে গা ছমছম তো করেই।

Advertisment

কেউ কেউ তো আবার সেই গার্স্টিন প্লেসের পিয়ানোর আওয়াজও শুনতে পান। কিংবা কারও মনে হয়, এই বুঝি কেউ হেঁটে গেল পাশ দিয়ে। এমনই সব হাড় হিম করা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফেরেন ঘোস্ট ওয়াকে অংশগ্রহণকারীরা।

ভূত কি আদৌ আছে? এ নিয়ে তো তর্কাতর্কির অন্ত নেই। কিন্তু এ শহরের হেরিটেজ বাড়িগুলোর অন্দরের ভূতুড়ে কাহিনি আজও রীতিমতো হট কেক। যেমন গার্স্টিন প্লেসের পিয়ানোর আওয়াজ, বা স্টেটসম্যান হাউসের পায়ের শব্দ। কলকাতার সেইসব ভূতুড়ে কাহিনির উপর ভর করে রুজিরুটি অনেকের। যাঁরা কিনা গভীর রাতে ঘোস্ট ওয়াক করান। গার্স্টিন প্লেস, রাইটার্স বিল্ডিং, হগ মার্কেট, হেস্টিংস হাউস, জিপিও, স্টেটসম্যান হাউসের মতো শহরের পুরনো বাড়িগুলোর আনাচাকানাচে ছড়িয়ে থাকা সেইসব ভূতুড়ে গপ্পো বলতে বলতেই এ শহরকে রাতের বেলায় হাঁটান 'লেট আস গো'-এর মতো সংস্থা। রাত এগারোটা থেকে ভোর সাড়ে তিনটে-চারটে পর্যন্ত চলে এই ওয়াক।

ভূত দেখেছেন কখনও? প্রশ্ন শুনে হাসলেন 'লেট আস গো'র সহ-প্রতিষ্ঠাতা দেবরাজ ভট্টাচার্য। বললেন, "অনেকেই প্রথমে জিজ্ঞেস করেন, 'ভূত দেখাবেন?' এ যেন খানিকটা জঙ্গলে বাঘ দেখতে পাব কিনা গোছের প্রশ্ন। তাও তো জঙ্গলে বাঘের দেখা মিলতে পারে। কিন্তু সত্যিই তো ভূত দেখা যায় না। তাই আমরা বোঝাই যে, ভূত দেখাতে পারব না। কিন্ত কলকাতার ওইসব পুরনো বাড়ির যেসব ভূতুড়ে কাহিনি রয়েছে, সেগুলো শোনানো হবে।''

ghost walk, ঘোস্ট ওয়াক নিঝুম রাতের থমথমে শহর। ছবি: লেট আস গো

এমন কোনও ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কখনও? জবাবে দেবরাজ শোনালেন এক ঘটনার কথা। ''তখন আমরা প্রথম প্রথম ঘোস্ট ওয়াক শুরু করেছি। হাইকোর্টের কাছে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে যে যাঁর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছের তলায় দাঁড়ান। এমন সময় আমাদের দলের একজন হঠাৎ চিৎকার করে গাছের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, তাঁর গায়ে নাকি পিছন থেকে কেউ ফুঁ দিয়েছে।''

আরও পড়ুন: ভূত-চতুর্দশীর আগে ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার গপ্পো টলিপাড়ার ছয় কন্যার

ঘোস্ট ওয়াক করাতে গিয়ে আরেক ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ঘোস্ট ওয়াকের গাইড অ্যান্টনি খাচাটুরিয়ানকে। তিনি বললেন, ''একবার ঘোস্ট ওয়াক করাচ্ছি। গার্স্টিন প্লেসে নিয়ে গিয়েছিলাম, যেখানে আগে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অফিস ছিল। বলছিলাম পিয়ানোর শব্দ শোনার কথা। বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম দুজন মহিলা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন যে, কিছুক্ষণ আগেই নাকি ওঁরা পিয়ানোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু জানতেন না এ কাহিনি। যখন বললাম পিয়ানোর কথা, তখন তা বুঝতে পেরেই খুব ভয় পেয়ে গেলেন। প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। তবে বাকিরা কেউ শুনতে পাননি।''

অনেক ঘোস্ট ওয়াক করলেও কোনও ভৌতিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন নি বা অনুভব করেন নি অ্যান্টনি। দেবরাজও বললেন, ''আমি ব্যক্তিগতভাবে মানি না এসব। তবে প্রত্যেকের মনের ব্যাপার। আসলে অত রাতে আলো-আধাঁরিতে ওইসব হাড়হিম ভূতের গল্প শুনলে তো গা ছমছম করবেই। তখন যাঁরা একটু দুর্বল, তাঁদের মনে কিছু হতেই পারে। ছোট গ্রুপে এটা বেশি হয়। তবে বড় গ্রুপ হলে অত মনে হয় না, কারণ ভিড় বেশি থাকে।''

ঘোস্ট ওয়াকে গিয়ে গা ছমছম করলেও আবারও যেতে চান ব্যাঙ্কে কর্মরত সিদ্ধান্বিতা রায়। তিনি বললেন, ''খুব ভাল লেগেছিল, খুব উপভোগ করেছি। রাতের বেলায় কলকাতাকে অন্যরকম লাগে। দিনের বেলায় ওই জায়গাগুলোতে গেলে যেরকম মনে হয়, রাতের বেলায় ছবিটা পুরো অন্য। তাছাড়া যেভাবে ইতিহাস বলা হয়, তা শুনতে বেশ লাগে। ভয় তো একটু লাগেই, গা ছমছম তো করেই। বিশেষত গার্স্টিন প্লেসে বেশ ভয় লেগেছিল। তবে সুযোগ হলে আবার যাব।''

সিদ্ধান্বিতার মতোই ঘোস্ট ওয়াকে হেঁটে খুশি ফটোগ্রাফার সুমন দাস। তিনি বললেন, ''খুব ভাল লেগেছিল। ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। আসলে ভূত তো দেখা যায় না। সেভাবে কিছু ফিলও করিনি। হয়তো ভূতেরাই ভয় পেয়েছিল আমাদের দেখে! তবে একবার হাঁটতে হাঁটতে দলছুট হয়েছিলাম। তখন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকটা জায়গায় বেশ গা ছমছম করেছিল।''

ঘোস্ট ওয়াকে অংশ নিয়েছেন ভারতীয় যাদুঘরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক সায়ন ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, "খুব ভাল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। গা ছমছম করা ব্যাপার তো ছিলই। তাছাড়া আমি যাদুঘরে কাজ করি। এখানেও অনেক গল্প আছে। এখানে ৪,০০০ বছরের পুরনো মমি আছে। এ নিয়ে অনেক কথা বলেন সবাই।''

ghost walk, ঘোস্ট ওয়াক আলো-আঁধার পরিবেশে ঘোস্ট ওয়াকে শোনানো হয় ভূতুড়ে কাহিনি। ছবি: লেট আস গো

অন্যদিকে, ভূতে রীতিমত বিশ্বাস করেন 'ঘোস্ট প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিস্ট'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সায়ন কুমার দে। তিনি বললেন, "ভূত বলুন, প্রেত বলুন, যাই বলুন, একটা স্পিরিট তো আছেই। আমরা বিভিন্ন জায়গাতেই যাই যাচাই করতে। বাগবাজারে চক্ররেল স্টেশনের কাছে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে, সেখানে আমরা পজিটিভি রেজাল্ট পেয়েছিলাম। শোভাবাজারে একটা বাড়িতেও পেয়েছিলাম। তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কিছু পাইনি। ইচ্ছে আছে আরেকবার যাওয়ার। সাউথ পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানেও কিছু পাইনি।'' উল্লেখ্য, ন্যাশনাল লাইব্রেরির ভূতের গল্প শহরে সবার মুখে মুখে ফেরে।

আরও পড়ুন: দীপাবলিতে আলোর বাজারে ঘনিয়েছে অন্ধকার

তবে ভূত নিয়ে তর্ক চলবেই , কিন্তু ভূতকে ঘিরে এ ধরনের ওয়াক যে পর্যটন শিল্পের পক্ষে ভাল, তা বলছেন যাদুঘরের সায়নবাবু। 'লেট আস গো'-র দেবরাজ যেমন বললেন, "আসলে কলকাতার পুরনো বাড়ির ইতিহাস বলা হয়, আর সেইসব বাড়িকে ঘিরে যেসব ভৌতিক কাহিনি রয়েছে তা শোনানো হয়।'' অ্যান্টনিও বললেন, "৬০ শতাংশ বলি কলকাতার ইতিহাস, আর ৪০ শতাংশ ভূতুড়ে কাহিনি।"

রাতের শহরে এ ধরনের ওয়াকে নিরাপত্তা কেমন থাকে? জবাবে দেবরাজ বললেন, "১০ জনের বেশি গ্রুপ হলে, পুলিশি নিরাপত্তা নিই। আর ১০ জনের কম দল হলে, যেসব জায়গায় আমরা ওয়াক করাই, সেখানকার স্থানীয় থানায় আগে থেকে জানিয়ে রাখি।'' ওয়াক নিয়ে কেমন সাড়া মিলছে? জবাবে দেবরাজ বললেন, ''ভালই সাড়া পাচ্ছি। খুব ইন্টারেস্টিং হল, মহিলাদের সংখ্যা বেশি থাকে। বিদেশিদের সংখ্যা খুব কম।''

আপনিও কি যেতে চান ঘোস্ট ওয়াকে? যোগাযোগ করুন ‘লেট আস গো’ সংস্থার সঙ্গে। এছাড়াও যোগাযোগ করতে পারেন ‘সিক শেরপা’ সংস্থার সঙ্গে।

kolkata
Advertisment