হালে গোটা কলকাতাটাই একেবারে যেন মুড়ে দেওয়া হয়েছে হাজার রকমের ক্যাফেতে। দু'পা এগোতে না এগোতেই গলির মোড়ে, বড় রাস্তায়, পুকুর পাড়ে, পাড়ার ছোট্ট পার্কে, বন্ধ হয়ে আসা সিনেমাহলে, নতুন গজিয়ে ওঠা শপিং মলে, ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে, স্কুল বাড়ির পাশে যত্র তত্র গজিয়ে উঠছে কাতারে কাতারে ক্যাফে। কিন্তু এরকমটা তো ছিল না আট দশক আগে। শহরের একেবারে হাতে গোনা কয়েকটা ক্যাফের মধ্যে অন্যতম ছিল হাজরা ক্যাফে। নাম অবশ্য শুধুই 'ক্যাফে'। মধ্য কলকাতায় হাজরা মোড়ের কাছে হওয়ায় লোকের মুখে মুখে ক্যাফে হয়ে উঠল হাজরা ক্যাফে।
কলকাতার আর পাঁচটা ক্যাফের থেকে কোথায় আলাদা হাজরা ক্যাফে? প্রায় পুরোটাই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর নেই, কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে মোটা মোটা গদিওলা ডুবে যাওয়া চেয়ার নেই, ক্যাপুচিনো, ক্যাফেমোকা, এসপ্রেসো নেই, আরও অনেক কিছুই নেই। না থাকার তালিকা নেহাত ছোট নয়। তবে যা আছে, তার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে পারবে না এই হালে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্যাফেগুলো। আট দশকের ইতিহাসের সঙ্গে পাল্লা দেবে কে?
১৯৩৭ সাল। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা অমরনাথ ব্যানার্জি ক্যাফে খুললেন সুদূর ভবানীপুর এলাকায়, হাজরা মোড়ের একেবারে কাছাকাছি (আশুতোষ কলেজের বিপরীতে)। আট দশকে একটুও পাল্টায়নি ক্যাফের চেহারা। একপাশে সেই খোপ খোপ করা কেবিন, সেই পুরোনো কাঠের চেয়ার, এমন কী সেই-ই পুরনো মেনু। চেহারা মোটেও ধোপদুরস্ত নয়, বাহারি আয়োজনও নেই। তা নিয়ে মাথাও ঘামান না অমরনাথ বাবুর ছেলে সিদ্ধেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, "এই প্রজন্মের কত ছেলেমেয়ে এসে আমায় বলে যায়, 'এই সাবেকি আমেজটার জন্যই আসা, পাল্টে ফেলবেন না' "। খান তিরিশেক চেয়ারের একেকটাতে এসে এককালে বসতেন উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবি, মান্না দেরা।
বাঁ দিক থেকে মাটন কবিরাজি, ফোম দেওয়া পুডিং
হাজরা ক্যাফের পুডিং জীবনে একবারও চেখে না দেখাটাকে রীতিমত অপরাধ হিসেবেই গন্য করেন শহরের খাদ্যরসিকদের একটা বড় অংশ। পুডিং-এর ওপর আলাদা করে ফোম দেওয়া। একেবারে অভিনব। এরকমটা আর কোথাও পাবেন না। চিকেন স্টু, ফিশ ফ্রাই, মটন কিমবা চিকেন কবিরাজিরও খুব চাহিদা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, ব্যবসা ধরে রাখতে ঘনঘন মেনুতে বদল আনতে হয় না এদের। সিসিডি-বারিস্তা-কেএফসি-র ভিড়ে দিব্যি টিকে আছে ১৯৩৭ সালের মেনু। রন্ধন প্রনালীতেও বদল হয়নি এতটুকু। নিয়মিত বেশ কিছুদিন যাতায়াতের সূত্রে ক্যাফেতুতো বন্ধুও হয়ে যান অনেকেই। ঝড়-জল-বৃষ্টি যাই হোক, ৩৬৫ দিন বিকেল ৪টে বাজতে না বাজতে খুলে যায় ক্যাফে। ছুটির দিনে আড্ডা গড়ায় বেশ কিছু রাত পর্যন্ত। রাত বাড়লে দোকানের ঝাঁপ পড়ে। কলকাতার সঙ্গে একটু একটু করে নিজেই জীবন্ত ইতিহাস হয়ে ওঠে হাজরা ক্যাফে।