বর্তমানে সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হার্টের সমস্যা। কার্ডিওলজি সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার অন্তর্গত ন্যাশনাল ইন্টারভেনশন কাউন্সিলের হিসাবে গত বছর প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হার্টের অসুখ নিয়ে সচেতনতার অভাবই যার অন্যতম মূল কারণ। এ ছাড়াও জীবনযাপনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, হাইপার টেনশন, অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান তো রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে শুধু মধ্যবয়স্করাই নন, ঝুঁকি রয়েছে শিশু এবং মহিলাদেরও। অনেকেই বুকের ব্যথাকে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেন, যার ফল মারাত্মক আকার নেয়। আপনি সেই ভুল করবেন না, রোগটাকে জেনে শনাক্ত করুন প্রথমে। এরপরই চিকিৎসা শুরু করুন যত দ্রুত সম্ভব। আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছেন শহরের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা।
হার্ট অ্যাটাক কী
হার্টের পেশির হঠাৎ রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়াই হার্ট অ্যাটাক। হার্টের পেশিতে রক্ত সঞ্চালন যখন ব্যহত হয় এবং হার্ট প্রয়োজনের তুলনায় কম রক্ত পায়, সেই অবস্থাকে বলা হয় ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ, যার একেবারে প্রথম পর্যায়ে থাকতে পারে স্টেবল অ্যাঞ্জাইনা, ব্লকেজ। এই ব্লকেজ আংশিক হলে রোগীর একটু বেশি হাঁটাচলাতেই বুকে ব্যথা করে, পাশাপাশি সামান্য উত্তেজনা, পরিশ্রমেও বুকে ব্যথা হয়। একটু বিশ্রাম নিলে সেই ব্যথা যদিও চলে যায়, তবে এরই চরম পরিণতি হার্ট অ্যাটাক। এইসময় বসে থাকা অবস্থাতেও যদি চরম ব্যথা হয়, বুঝতে হবে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
হার্ট অ্যাটাক, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট, হার্ট ফেলিওর এক নয়
হঠাৎ হওয়া কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এবং হার্ট অ্যাটাক কিন্তু এক নয়, অনেকেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা হার্ট অ্যাটাকের পার্থক্যটা বোঝেন না, ফলে সমস্যায় পড়ে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে নেন রোগীর পরিবার। করোনারি আর্টারির কাজ হৃদপিন্ডে রক্ত পাঠানো, এবার কোনও কারণে একটি করোনারি আর্টারির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক হয়। এ ক্ষেত্রে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্টে অক্সিজেন পৌঁছায় না, এবং সেই জায়গার কোষগুলো মরে যায়। তবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ আলাদা, এ ক্ষেত্রে অ্যারিদমিয়ার কারণে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: Viral Diseases: ভাইরাল জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিক নয়
এক বা একাধিক ব্লকেজের কারণে রক্তনালির মাধ্যমে রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্ট অ্যাটাক হয়। তবে এসময় ব্যক্তি স্বজ্ঞানে থাকেন এবং শ্বাসকার্য চালতে থাকে। অন্যদিকে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট একধরনের বৈদ্যুতিক সমস্যা বলা যেতে পারে। হৃদপিন্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দনের ফলে মস্তিষ্ক সহ শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোয় রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যাহত হয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যান। যাঁদের করোনারি আর্টারির সমস্যা রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ চিকিৎসা না হলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। হার্ট ফেলিওর থেকে সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ হতে পারে। পাশাপাশি হার্টের স্বাভাবিক কাজ, অর্থাৎ পাম্প করে রক্তকে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দেওয়ার অক্ষমতাকেই হার্ট ফেলিওর বলা হয়।
হার্ট অ্যাটাকের আগাম উপসর্গ হয় কি?
এক্ষেত্রে অনেক সময় উপসর্গ দেখা দিতেও পারে, আবার নাও দেখা দিতে পারে। উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হলো হাঁটতে গিয়ে বুকে চাপ। অনেকেই এই ব্যথাকে গ্যাসের সমস্যা ভেবে ভুল করেন। দিনের পর দিন একই ব্যাপার চলতে থাকলে বুঝতে হবে তা খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে রাতে ঘুমের মধ্যে বুকে চাপ, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে আর ঘুম না আসা, ঘুম থেকে উঠে সকালে শরীর খারাপ লাগা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। অনেকেই এই বিষয়কে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ভুল করে থাকেন। মনে রাখতে হবে সিভিয়ার প্যানক্রিয়াটাইটিস ছাড়া এমন ব্যথা হয় না। কাজেই বুঝে নিতে হবে এগুলো হার্ট থেকেই হচ্ছে।
চিকিৎসা কী?
হার্ট অ্যাটাকের প্রথম এবং প্রাথমিক চিকিৎসা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের খুব কম লোক এই চিকিৎসা পান। দেখা যায়, ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বাধাপ্রাপ্ত ধমনী সময়মতো খোলা হয়ে ওঠেনি। যার একটা বড় কারণ সচেতনতার অভাব। অ্যাটাকের পর রোগী বা তাঁর পরিবারকে কী করতে হবে সে বিষয়ে জ্ঞানের অভাব রয়েছে বেশিরভাগের মধ্যেই।
হার্ট অ্যাটাকে কী করণীয়
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী এক ঘণ্টাকে গোল্ডেন সময় বলে, এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা না হলে চিকিৎসায় সাড়া নাও মিলতে পারে। খুব বেশী হলেও দুঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন: Skin Care Tips: শীত আসছে, ডাক্তারবাবু বলছেন, ‘ত্বকের যত্ন নিন’
যাঁদের একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাঁরা সতর্ক থাকুন
হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং স্টেন্ট বসেছে তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ খান, বিশেষ করে অ্যান্টিপ্লেটলেট ড্রাগ - যেগুলি রক্ত তরল রাখার জন্য দেওয়া হয়, সেগুলি নিতে ভুলবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনওই হঠাৎ করে ওষুধ বন্ধ করবেন না। ওষুধের পাশাপাশি রুটিন চেকআপ করান, আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। বুকে কোনওরকম অস্বস্তি হওয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। একবার হার্ট অ্যাটাক হলে বারবার হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে বা বিমানে হার্ট অ্যাটাক হলে কী করবেন
বিমানে থাকলে জরুরি অবতরণ করাতে হবে। বিমানে থাকা অক্সিজেন মাস্ক দিতে হবে রোগীকে। রোগীকে অ্যাসপিরিন দিন। আক্রান্তকে সোজা করে শুইয়ে দিন। দেখুন রোগী অজ্ঞান হয়েছেন কিনা, অজ্ঞান হলে বুঝতে হবে হার্ট অ্যাটাক নয়, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। এ সময় পালস দেখতে গিয়ে বা অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যান। রোগীকে শুইয়ে দিয়ে বুকের ওপর চাপ দিন (খুব জোরে বা খুব আস্তে নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ)। এই প্রক্রিয়া হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত ক্রমাগত চালান। এ ছাড়াও যাঁরা সফর করছেন তাঁরা অ্যাসপিরিন সঙ্গে রাখুন। জরুরি প্রয়োজনে নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট একটার বেশি দেবেন না। রোগীর সঙ্গে চিকিৎসার সমস্ত কাগজ ও ওষুধ রাখুন।
ঝুঁকি কাদের
হার্ট বা করোনারির রক্তনালিজনিত সমস্যা থাকলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সম্ভবনা রয়েছে, এ ছাড়াও হার্টের সমস্যার পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, রক্তে বেশিমাত্রায় কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি, চাইপ টু ডায়াবেটিস, হরমোন ঘটিত সমস্যা, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, ধূমপান, মদ্যপান। মূলত মধ্যবয়স্কদের ঝুঁকি বেশি হলেও বর্তমানে কমবয়সীরাও যথেষ্ট ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। হার্ট ফেলিওরের ক্ষেত্রে মহিলাদের ঝুঁকি বেশি।
নজর দিন ডায়েট এবং শরীরচর্চাতেও
শর্করা জাতীয় খাবার যেমন, চিনি, গুড়, মধু, মিষ্টি এসব বাদ দিন, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট না খাওয়াই ভাল। রেড মিট-এ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে কাজেই রেড মিট না খাওয়াই ভাল। মাংসের মেটে, মাছের ডিম ইত্যাদিতে কোলেস্টেরল থাকে কাজেই এ সমস্ত বাদ দিন খাদ্যতালিকা থেকে। ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে এমন কিছু খাবেন না। অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান ছাড়ুন আজই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফ্রিহ্যান্ড করুন। পাশাপাশি প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন।